আপসহীন সংগ্রামী জননেতা-ড. এ কে আজাদ চৌধুরী


বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। শুধু বাংলাদেশের নয়, এ অঞ্চলের এবং বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দিনটি ছিল ১৭ মার্চ। মার্চ মাস আমাদের কাছে বিভিন্ন দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অন্যদিকে এ মাসেই জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি না এলে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন এ দেশ আমরা পেতাম না। শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি আমরা। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল বৈকি। আজ বিশ্বে বাংলাদেশ যে সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছে, সর্বোপরি যে অবস্থান করে নিয়েছে, ’৭১ সাল এবং তার আগে তেমনটি ছিল না। আজকের মতো ছিল না সে সময়ের বিশ্ব বাস্তবতা। অনেক জাতিই মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম করছিল সে সময়ে। অনেকেই সফল হতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিলেন। বলতে গেলে বঙ্গবন্ধুর জন্মের মধ্য দিয়ে একটি জাতি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ তথা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে কী করে একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল এবং সে জাতি রাষ্ট্র আজ বিশ্বে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত, তা এক বিস্ময়ও বটে। এজন্যও বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি শুধু আমাদেরই নয়, সারা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছেন, জনতার নেতার কোনো দিন পরাজয় হয় না এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রাম কোনো দিন বিফলে যায় না।

বঙ্গবন্ধু যখন সংগ্রাম করছেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন কারাগারে। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে বঙ্গবন্ধুর। তিনি সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন অনেক দিন। জীবনের অধিকাংশ সময় তার কেটেছে জেলে। বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্কুল জীবন থেকেই তিনি জেল খেটেছেন ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় ও সংগ্রামের জন্য। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে নয়। অবিভক্ত বাংলায় এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের স্কুল পরিদর্শনে। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমার স্কুলের ছাদ ভাঙা কেন? ১০-১২ বছরের একটি ছেলের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তখন সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যা ছিল অবিশ্বাস্য। সেই থেকে তার সংগ্রাম চলেছে। জীবনের শেষ সময়েও তিনি সংগ্রামের মধ্যেই ছিলেন। এর পর বঙ্গবন্ধু পড়তে যান কলকাতায়। সে সময়ে কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন তিনি। বেকার হোস্টেলে থাকাকালীন কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগে। সোহরাওয়ার্দী তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তার পক্ষেও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে তেমনভাবে সহায়তা করছিল না। সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুর কাছে সাহায্য চেয়ে বলেছিলেন, তুমি কি তোমার যুবকদের নিয়ে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আমাকে সাহায্য করতে পার? বঙ্গবন্ধু ১৯৪৬ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে। যেখানে হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানেই তিনি দাঁড়িয়েছেন। মুসলমান আক্রান্ত হলেও পাশে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু, জুগিয়েছেন সাহস। সবাইকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বেকার হোস্টেল মুসলিম শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল হলেও সেখানে হিন্দুরা নির্ভয়ে আশ্রয় নিত এবং চলাফেরা করত।

বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই সংগ্রামের জীবন। দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৪৮ সালেই বাংলা ভাষার দাবিতে আবারো সংগ্রাম শুরু করেন। ফলাফল কারারুদ্ধ হলেন। জেল থেকে বের হয়ে দ্বিগুণ গতিতে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ন্যায্য বেতন-ভাতার দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। সেখানেও বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অনেককে সঙ্গে নিয়ে তত্কালীন উপাচার্যের বাড়ির সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন তিনি। পরবর্তীতে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করে। তখন তিনি আইন বিভাগের ছাত্র। এতে দমে যাননি বঙ্গবন্ধু। জীবনে কোনো দিন আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু বহিষ্কার আদেশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যান। তবে স্বাধিকার ও ভাষার আন্দোলন তিনি চালিয়ে গেছেন। সংগ্রামের জন্য সেই সময়ে আবার তিনি কারারুদ্ধ হলেন। দীর্ঘ কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে। জেলে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুকে চিকিৎসা দিতে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন মেডিকেল কলেজ। চিকিৎসা নেয়ার সময়ও তিনি ছাত্রদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করলেন চিরকুট দিয়ে— কীভাবে বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এর জন্য বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জে স্টিমার ধরতে না পারায় রাতে হোটেলে অবস্থান করতে হয় তাকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হোটেলের পেছনে লোকদের সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধু তাদের উৎসাহিত করেন আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য। পরে ফরিদপুর কারাগারের অভ্যন্তরেই আমরণ অনশন শুরু করেন রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য, ভাষার জন্য। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংগ্রাম করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে এ জাতিকে মুক্ত করেছেন। এর মাঝে ছয় দফা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৭০-এর সফল নির্বাচন, ’৭১-এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ তারই নেতৃত্ব ও সংগ্রামের ফসল। সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু জনতার মাঝে থেকেই সাধারণ মানুষের একজন হয়েও সারা দেশের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজ বিশ্বে নন্দিত ও প্রশংসিত। অমর্ত্য সেন বারবারই বলছেন, মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমনকি ভারতের মতো দেশেরও বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখা উচিত। সেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তার জন্মদিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ এ সন্তানকে স্মরণ করছি।

এ কে আজাদ চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায়) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

SUMMARY

2118-1.jpg