মোরসালিন মিজান ॥
তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ/ও মোর ভালোবাসার ধন...। বাঙালীর ভালবাসার ধন বঙ্গবন্ধুকে আবারও ফিরে পাওয়া হলো। পঁচাত্তরে মহান নেতাকে হারানো যে ফিরে পাওয়ার প্রয়োজনেই, আরও একবার তা মনে করিয়ে দিল ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ সদ্য প্রকাশিত বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে হাতের আঙুল কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর যে অদ্ভুত শিহরণ, টের পাওয়া যায়। তার চেয়ে বড় কথা- আবিষ্কারের আনন্দ। শেখ মুজিবুর রহমান নামটি মুছে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রের সরকারের অযুত ষড়যন্ত্র। দেশী-বিদেশী তৎপরতা। অথচ ইতিহাস নিজের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখল তার বরপুত্রকে। শুধু বাঁচিয়ে রাখা কেন? নতুন নতুন রূপে সামনে আনছে।
এবার যে দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার প্রয়াস, তা আলাদা তাৎপর্যের। নতুন গ্রন্থে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের চোখে দেখা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বা আইবি। প্রতিদিনের কর্মকান্ড বক্তৃতা পর্যবেক্ষণ করে। বিবৃতি লিফলেট ইত্যাদি সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে নিজেদের মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করে। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমান নামে বিশালাকার ফাইল। স্পেশাল ব্রাঞ্চে খোলা ব্যক্তিগত ফাইলে জমা হয় দীর্ঘ ২৩ বছরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন। আইবি’র সদস্যরা, কী ভয়ানক কান্ড, মোট ৪০ হাজার প্রতিবেদন দাখিল করেছিল!
এসব প্রতিবেদনের আলোকে ১৪ খন্ডের প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হাক্কানী পাবলিশার্স ইতোমধ্যে প্রথম খন্ডটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে। গ্রন্থ সম্পাদনার কাজ করেছেন পিতার সুযোগ্য কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শেখ হাসিনা। এ ধরনের পুরনো প্রাচীন সরকারী সিক্রেট ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে সংগ্রহের চিন্তা, এ কাজে সফল হওয়া, সর্বোপরি গ্রন্থাকারে প্রকাশ- বড় এবং বিরল ঘটনা। যারপরনাই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তা সত্তে¡ও শতভাগ উৎড়ে গেছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দু’ বোন পিতাকে আরও একবার আবিষ্কার করেননি শুধু, নিজেদের ইতিহাস চেতনা ও দায়বোধের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আগামী দিনের গবেষকদের হাতে রত্ন ভান্ডর তুলে দিয়েছেন তাঁরা। বইয়ে উঠে আসা অনেক ঘটনাবলী আগে থেকেই জানা। তবে ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলের আলোকে নীরিক্ষা করে নেয়ার সুযোগ করে দেবে নতুন বইটি।
এর কিছুকাল আগে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে নিজ জবানীতে পাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় বাঙালীর মহান নেতা তাঁর জীবনের ঘটনাবলী লিখতে শুরু করেছিলেন। খুব বেশি দূর এগোতে পারেননি, যেটুকু লেখা, বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাতেই বিস্ময় কাটে না। এখনও বইটির পাতায় বুঁদ হয়ে আছেন পাঠক। এর পরপরই প্রকাশিত হয় ‘কারাগারের রোজনামচা।’ এতে শেখ মুজিবুর রহমানের জেল জীবনের দুঃসহ স্মৃতি। ডায়েরি হিসেবে নিজেই লিখেছিলেন তিনি। গ্রন্থ আকারে পেয়ে নেতার আত্মত্যাগ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ পান পাঠক।
ধারাবাহিক প্রকাশনার এ পর্যায়ে পাওয়া হলো ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ এখানেও আপসহীন চির সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য। তবে স্বতন্ত্র আবেদন লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তানী শত্রæদের ব্যাখ্যা থেকে পরম মিত্রকে খুঁজে নেয়ার এমন আনন্দ আগে কখনও হয়নি। বইয়ের প্রথমভাগে ফাইলের মলিন প্রচ্ছদটি যুক্ত করা হয়েছে। ফাইলের নম্বর পিএফ ৬০৬-৪৮। ওপরের দিকে ছোট করে শেখ মুজিুবর রহমানের নামটি লেখা। আর বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কনফিডেন্সিয়াল।’ বইতে তুলে ধরা সব ডকুমেন্ট ইংরেজীতে লেখা। কখনও হাতে লেখা হয়েছে। কখনও টাইপ রাইটারে। এসব ডকুমেন্টের ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে গ্রন্থটি।
প্রথম খন্ড ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সালের ঘটনাবলী বিধৃত করা হয়েছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ শুরু করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে অনুসরণ করার মতো অনেক কারণ ছিল। তাই বলে এত আগে থেকে? আজ ভাবলে অবাক হতে হয়। কারণ তখনও শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছেন। আইন বিভাগে মাস্টার্স শুরু করেছেন। অবশ্য শুধু ছাত্রটি হয়ে তিনি ছিলেন না। দেশভাগের আগে ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই মুজিব এক সম্ভাবনার নাম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো কিংবদন্তি নেতা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন। ওইটুকুন বয়সে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনকে বেগবান করতে অত্যন্ত কার্যকর ভ‚মিকা রেখেছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্য এই যে, স্বপ্নের পাকিস্তান অচিরেই তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল। নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। প্রথমেই ভাষার লড়াই। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ দাখিল করা গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে ভাষা সংগ্রামী শেখ মুজিবের নাম পাওয়া যায়। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ দেয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলরত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশ ঘুরে বক্তৃতা করেছেন। জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর জ্বালাময়ী প্রতিটি বক্তৃতা সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দারা। এর পাশে নোট লিখে উর্ধতনদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এমন বেশকিছু প্রতিবেদন বইতে যুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বিবৃতির অনুলিপি। ১৯৪৯ সালের ১০ জানুয়ারি দেয়া একটি বিবৃতিতে জুলুম প্রতিরোধের আহন জানান শেখ মুজিব। কড়া সমালোচনা করেন তৎকালীন সরকারের। এভাবে তাঁর জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটি যেন পাওয়া হয়ে যায় পাঠকের। ১৯৪৯ সালের ১১ আগস্ট পাঠানো একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ‘আনসুইটেবল’ সময়ের কারণে সম্ভব করতে পারছেন না। খ্যাতিমান সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুসরণ করে এই তথ্য পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনের নিচের দিকে ছোট্ট নোট- ‘সাবমিটেড ফর ফেভার অব নেসেসারি এ্যাকশন।’ ১৯৫০ সালের প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের যুগ্ম সম্পাদক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশকারী পত্রিকার কপি। বোনের সঙ্গে মুজিব দেখা করতে চান। সেই আবেদন। শেখ মুজিবের নিজের লেখা এবং বঙ্গবন্ধুকে লেখা অনেক চিঠি যুক্ত করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। জেলা ও মহকুমার নেতাদের লেখা সব চিঠি প্রাপকের হাতে পৌঁছেনি। চলে গিয়েছে গোয়েন্দা দফতরে। একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে লেখা বহু চিঠি মাঝপথে গিলে ফেলে আইবি। এমন অনেকগুলো অপঠিত চিঠি সে সময়ের সরকারের নষ্ট রাজনীতির পরিচয় দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর লেখা একটি চিঠি পাঠে জানা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতাদের আইনী সহায়তা দিতে তাদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইছেন। ১৯৫০ সালের ২১ জুলাই লেখা আবেদন গ্রাহ্য করেনি অমানবিক সরকার। এমনকি বিনা বিচারে বন্দী শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১৫ মে জেলে থেকে আইন পরীক্ষা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে লিখিত আবেদন জানান। কিন্তু জরুরী এ আবেদন শোনারও কেউ ছিল না তখন। এসবের বাইরে মুজিবের নামে, আহা, কত যে মামলা রুজু হয়েছিল! মিথ্যা মামলায় জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। বইতে বিভিন্ন সময় দায়েরকৃত মামলার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আছে চমকিত হওয়ার মতো আরও অনেক তথ্য-উপাত্ত। এবং সব তথ্য-উপাত্তই শেখ মুজিবকে আপোসহীন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঙালীর সংগ্রামের আলেখ্য হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে এই গ্রন্থ পাঠ আত্মসমালোচনারও সুযোগ করে দেয় বলে মনে করি। সেই কবে কোন কালে শেখ মুজিবুর রহমানকে চিনেছিল পাকিস্তানীরা! অথচ এত এত কাল পরও আমরা বাঙালীরা অনেকেই তাঁকে চিনতে পারিনি। জাতির পিতাকে স্বীকার করতে এখনও দ্বিধা। গ্রন্থ পাঠে তাই কিছুটা হলেও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন।
এ পর্যায়ে এসে না বললেই নয় যে, অসামান্য এই গ্রন্থ প্রকাশের পুরোভাগেই রয়েছেন শেখ হাসিনা। ইতিহাসের উপাদান রক্ষায়, লালনে তাঁর তুলনা কেবলই তিনি। বহু সাধনায় অমূল্য নথি সংগ্রহ করার কথা বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন তিনি। ডকুমেন্ট সংগ্রহসহ প্রাসঙ্গিক অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমি তখনই এই ফাইলগুলো সংগ্রহ করি এবং ১৯৯৭ সালে ফটোকপি করে রেখে পুনরায় ফাইলগুলো এসবি অফিসে ফেরত পাঠাই। ডকুমেন্টগুলো গোয়েন্দা সংস্থার গোপনীয় দলিল হওয়ায় ডি-ক্লাসিফাইড করা হয়। তিন কপি করে এক সেট আমেরিকায় জয়ের কাছে পাঠাই। জয় সেটা ড. এনায়েত রহিমের কাছে দেয়, কারণ তিনি ইতিহাসবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর গবেষণা করছিলেন। এক সেট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রেখে দেই। একটা সেট নিয়ে আমি ও বেবি মওদুদ কাজ করতে শুরু করি। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর এসবিকেই দায়িত্ব দেই এই ফাইলগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে এবং মূল ডকুমেন্ট স্ক্যান করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংগ্রহ করার জন্য। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই কাজটা তারা সম্পন্ন করেছেন। একটা টিম দিনরাত পরিশ্রম করেছে।’
দ্বিতীয় দফায় ডকুমেন্ট উদ্ধারকারী টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য তাকে দীর্ঘদিন এই পদে রাখেন বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য এর আগে সমস্ত ফাইল সংগ্রহ করেন এসবির ডিআইজি সামসুদ্দিনের সময়। এই রত্ন ভান্ডারের খোঁজ তার কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা।