বছর যায়, বছর আসে। প্রতি বছর নিয়ম করে আগস্ট মাস আসে, আবার শেষও হয়ে যায়। কিন্তু শেষ হয় না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য শোকগাথা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এ মাসেই হারিয়েছি আমরা। তাই আগস্টজুড়ে বাঙালি জাতি তার জনকের জন্য শোকে মুহ্যমান থাকে।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিনি তার জীবন, চিন্তাভাবনা ও শ্রম উৎসর্গ করেছিলেন যাতে এ দেশের মানুষ আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে- মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে স্বাধীনতার জন্য, আর পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। স্বাধীনতা এনে দিলেও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধু তার ৫৫ বছরের জীবনে শুধু জেলেই কাটিয়েছেন চার হাজার ছয়শ’ ৭৫ দিন, যা বছরের হিসাবে প্রায় ১৩ বছর। অর্থাৎ তার যৌবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় তাকে থাকতে হয়েছে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে। একাকী, নিঃসঙ্গ, পরিবার-পরিজনহীন। তিনি যদি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করতেন, হয়তো এত দীর্ঘ সময় জেলে কাটাতে হতো না। আরাম-আয়েশে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে দিন কাটাতে পারতেন। নিদেনপক্ষে স্ত্রী সন্তান-নিয়ে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তিনি ভেবেছেন শুধু দেশ নিয়ে, এ দেশের জনগণ নিয়ে। এ দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপস করেননি। নিজের আরাম-আয়েশ আর সুখের কথাও ভাবেননি। যার প্রমাণ আমরা পাই, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলের মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে। হয়তো প্যারোলে মুক্তি নিলে তিনি অনেক আগেই জেল থেকে ছাড়া পেতেন। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যে মুক্তি-সংগ্রাম সেটি আঘাতপ্রাপ্ত হতো। তাই তার জীবন-শঙ্কা থাকার পরও ঘৃণাভরে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শুধু তার জেলজীবনের দিকে তাকালেই এ রকম অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়।
জাতির পিতার নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে বারবার তার ছোট সন্তান শেখ রাসেলের কথা উঠে এসেছে। একজন বাবার জন্য সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকা বরাবরই নিদারুণ কষ্টের। সেটা যদি দুধের শিশু হয় তাহলে তা বর্ণনাতীত। শেখ রাসেলকে ছেড়ে টানা অনেকদিন জেলে থাকায় বঙ্গবন্ধু কষ্ট পাওয়ার কথা সরাসরি লেখেননি, কিন্তু রাসেলকেন্দ্রিক দু-একটি ঘটনা থেকে সেটা স্পষ্ট হতে বাকি থাকে না।
রাজনীতির জন্য চাকরি ছেড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির জন্য মন্ত্রিত্বও ছেড়েছিলেন তিনি। তার রাজনীতির মূলমন্ত্রই ছিল আদর্শের জন্য সংগ্রাম, আদর্শের জন্য ত্যাগ। যে আদর্শ, বিশ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে তিনি রাজনীতি করতেন, শত কষ্ট ও প্রচণ্ড চাপেও তিনি তাতে অটল ছিলেন। সেটা আমরা দেখতে পাই তার ছাত্রজীবন থেকেই। ১৯৩৯ সালে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার কারাবরণ শুরু। এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, অসহযোগ এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটা ধাপেই তিনি সফল। এ সফলতার পেছনে আছে দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রম, নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে জেল-জুলুম-অত্যাচার মেনে নেয়া। আর তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার মানুষের প্রিয়পাত্র, তাদের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শারীরিকভাবে আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও তার জীবন ও রাজনীতি, বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তন ধারায়, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা- সবই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি মিশে আছেন আমাদের চিন্তা-চেতনা-আলোচনায়। তার উপস্থিতি সর্বত্র। রাজনীতি, রাষ্ট্র ও প্রাত্যহিক জীবনে তিনি আছেন পাথেয় হয়ে।