সৌম্য সালেক
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বাঙালির অধিকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখেন। এদেশের সাধারণ মানুষের অধিকার, আকাঙ্ক্ষা পূরণের সংগ্রামে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দেন, এজন্যে তাঁকে বারবার কারা বরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাহস, বাগ্মিতা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এদেশের সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ছিল ইসলামের উদারনৈতিকতায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক, সাম্য ও মৈত্রীর চিরন্তন আদর্শে উদ্ভাসিত। এদেশে তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের প্রচার-প্রসারে তিনি যে যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন তা সমকালীন ইতিহাসে বিরল। তবুও ইসলামের তথাকথিত লেবাসধারীরা অব্যাহতভাবে তাঁকে ইসলাম-বিদ্বেষী বলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে ইসলামের চিরন্তন কল্যাণকামী রূপের প্রতি তিনি কতটুকু মোহিত এবং তিনি যে ইসলামের প্রকৃত উদার মহিমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন "আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূল করীম (সাঃ)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফেকদের বিরুদ্ধে, যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারেন তারাই ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা শায়েস্তা করার জন্য।" বঙ্গবন্ধু তাঁর এ অমূল্য বক্তব্যে রাসূল (সাঃ)-এর ইসলাম, ইসলামের সুমহান শিক্ষা, অন্যায় অত্যাচার শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ইসলামের আপোষহীন অবস্থানের প্রতি তাঁর সুদৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল মদীনার সনদের সেই শিক্ষা, যেখানে উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল -"মদীনায় ইহুদী-নাসারা পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।" বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন খাঁটি বাঙালি তেমনি ছিলেন একজন ঈমানদার মুসলমান। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে তিনি যে নির্বাচনী অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, নির্বাচনের সেই অঙ্গীকার তিনি তাঁর সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। তিনি ওয়াদা খেলাফ বা ধোঁকাবাজির রাজনীতি করেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এমন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, যদি তিনি পূর্বের অঙ্গীকার ভুলে নতুন ভাবে নতুন পন্থায় কাজ করতেন তবুও তার বিরুদ্ধে বাধা দেয়ার সাহস কেউ পেত না। কিন্তু ঈমানদার মানুষ কখনোই তাঁর অঙ্গীকার খেয়ানত করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনমানসে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অবদান রেখে গেছেন সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত বিরল। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত ইসলাম ধর্মীয় কার্যক্রমের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হলো:- ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা - ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংস্থা হিসেবে পরিচিত। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত পবিত্র কুরআনের বাংলা তরজমা, তাফসীর, হাদীস গ্রন্থের অনুবাদ, রাসূল (সাঃ)-এর জীবন ও কর্মের উপর রচিত ও অনুদিত গ্রন্থ ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন ও দর্শন, ইসলামী অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবী ও মনীষীগণের জীবনী ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আর্ত-মানবতার সেবায় ২৮টি ইসলামিক মিশন, ৭টি প্রশিক্ষণ একাডেমি, ২৮ খণ্ডে ইসলামী বিশ্বকোষ, ১২ খণ্ডে সীরাত বিশ্বকোষ প্রকাশ করে ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ সীরাতি মজলিশ প্রতিষ্ঠা - স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্কানী আলেম-ওলমাদের সংগঠিত করে ইসলামের সঠিক রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে তাঁর নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় 'সীরাত মজলিস' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিল উদ্যাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিলের উদ্বোধন উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। হজ্ব পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা - পাকিস্তান আমলে হজ্ব যাত্রীদের জন্যে কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজ্বযাত্রীদের জন্যে সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন - ইসলামী আকিদা ভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। এ লক্ষ্যে মাদ্রাসা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে নাম দেন 'বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড।' বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার - বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে কুরআন তিলাওয়াত ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে বেতার ও টিভির অনুষ্ঠানের শুভ সূচনাকাল ও দিনের কর্মসূচির সমাপ্তি কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ), শব-ই কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি - বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ), শব-ই ক্বদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। দিনগুলোতে পবিত্রতা রক্ষার জন্যে সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। বিশ্ব এজতেমার জন্যে টঙ্গীতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ - তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। এ সংগঠনটি যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব এজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। এছাড়া কাকরাইলের তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ, ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধকরণ, রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা, আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ, ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য ইসলাম ধর্মীয় কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে বিপুল পরিমাণ কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন এবং অভূতপূর্ব নিদর্শন রেখে গেছেন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যেদিন আমরা অপবাদ আর বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব সে দিনই সম্ভব হবে তাঁর অসামান্য ঋণের কিঞ্চিৎ পরিশোধ করতে। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়টি বর্ণনা করতে হলে একটু আগে আমরা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করতে পারি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে মুসলমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রাজা নয়, বাদশা নয়, বর্গী নয় বা নয় কোন বর্গীমার্কা জনগোষ্ঠী। সাত সাগর পাড়ের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের (ইস্ট ইন্ডয়া কোম্পানি) কাছে পরাজয়ের বেদনা এবং অপমানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ আধুনিক যুগে পা রাখে। দেশীয় অমাত্যবর্গ এবং বিদেশী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই কোম্পানীর বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড লাভ করে। বিভেদনীতি ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় শিক্ষার যে মুক্ত বাতাস এসেছিল তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। শোষণ, বঞ্চনা ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধমে ব্রিটিশরা যাত্রা শুরু করে। দেখা দেয় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), শমসের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-১৭৬৮), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭), সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৩), গারো বিদ্রোহ (১৮৩৭-১৮৮২), সাওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৭), সন্দীপ বিদ্রোহ (১৭৬৯), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬১), ওয়াহাবী বিদ্রোহ (১৮৩১), ফরায়েজী বিদ্রোহ (১৮৩৮-১৮৪৮) এবং সর্বোপরি সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭)। এখানেই থেমে থাকেনি বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন উল্লেখযোগ্য। প্রায় দুশ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হিসেবে বাংলা ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশ। তবে স্বাধীনতার ডাক এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বাঙালিরাই দেয়। তিতুমীর থেকে সূর্যসেন, মজনু শাহ থেকে সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম বিদ্রোহী সিপাহী মঙ্গল পান্ডে সবাই বাংলার কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, বাঙালিদেরই সৃষ্টি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শেষ মুহূর্তে হিন্দু মুসলমানদের দ্বিধাবিভক্তি ব্রিটিশদের কূটকৌশলেই ঘটে। ১৯২০ সালের তেমনি এক মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি বিপ্লবী বাঙালির সূর্যসন্তান। লাখো শহীদ অগ্রজ ভাইদের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠলেন পরে। ১৯৪২ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শেখ মুজিব উচ্চ শিক্ষার্থে কলিকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) ভর্তি হন এবং সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। সময়টি ছিল বাংলার ইতিহাসে এক উত্তাল সময়। শেরেবাংলা, নেতাজী, সোহরাওয়ার্দী আর আবুল হাশিমের মতো বাঘা বাঘা নেতা বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয়। দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ আর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পাশাপাশি কংগ্রেস-মুসলিম লীগের বিভেদের রাজনীতিতে ক্ষত বিক্ষত বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক জীবন। মুজিবের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিকাশ হয়েছিল এহেন বিরাজমান আবহে। উদার গণতান্ত্রিক চেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয় ঐক্যের চেতনায় তাঁর দীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের সানি্নধ্যে। শেখ মুজিব এ সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৬-এর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা হিসেবে যে অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা তাঁকে পরবর্তী জীবনে হিংসা-দ্বেষের বিপরীতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি আস্থাবান করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি চলে আসেন পূর্ব বাংলায় এবং ঢাকাকে তাঁর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। দেশ বিভাগের পূর্বে স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বাংলা গঠনের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ চন্দ্র বসু। বিভক্ত ভারত ও পাকিস্তান দাবি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও স্বতন্ত্র এই প্রস্তাব কার্যত বাঙালি জাতীয়তাবাদের সারোৎসার। কিন্তু সময় ছিল বৈরী। হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ বুদ্ধি সম্প্রদায় দুটিকে এত দূরত্বে নিয়ে গিয়েছিল যে, অবিভক্ত বাংলার দাবি কাগজপত্রে বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বাংলা গঠনের এই দাবি শেখ মুজিবের অন্তরাত্মায় এক স্বাধীন বাংলার স্বপ্নকে চিরস্থায়ী করে গেঁথে দেয়। ভাষা আন্দোলন - দেশ বিভাগের পরপরই পূর্ব বাংলার রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে পূর্ব-বাংলা সফরে এসে ঘোষণা দেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। তাঁর এ ঘোষণা দেশের বিশেষত পূর্ববাংলার জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। শেখ মুজিব সহ ছাত্র নেতারা তীব্র ভাষায় এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হলে পূর্ববাংলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবসহ পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেকে। তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। সামরিক শাসন - পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে বিশৃঙ্খলা ও ডেপুটি স্পীকার নিহত হওয়ার কারণে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সহজেই এ অঞ্চলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অজুহাত খুঁজে পায়। এ ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এক ঘোষণা বলে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি দেশের শাসনতন্ত্র আইন পরিষদ, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। নতুন সামরিক সরকার পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে আবুল মনসুর আহমদ এবং শেখ মুজিবসহ বহু নেতা ও পরিষদ সদস্যকে গ্রেফতার করে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জার ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটে। প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আইয়ুব খান মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। সামরিক শাসন কখনো শুভ কিছু আনতে পারে না। সারা পৃথিবীতে একটিও উদাহরণ নেই, যেখানে সামরিক শাসন একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পেরেছে। আইয়ুব খানও পারেনি। ছয় দফা - দেশে সামরিক শাসন, তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর এক রকম বঞ্চনা, কাজেই বাঙালিরা সেটি সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাঙালিদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের তেজস্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ছিল পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের সবরকম অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির এক অসাধারণ দলিল। ফলে দিনে দিনে ৬ দফা কর্মসূচির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৬ দফার এ জনপ্রিয়তায় সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ৬ দফাকে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন বলে অপব্যাখ্যা করতে থাকে। এরপর সরকার ৬ দফা আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য দমন নীতির আশ্রয় নিয়ে ১৯৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিবসহ বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে। এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। অতঃপর বন্দী নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রদেশব্যাপী এক সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেয়। সরকার হরতাল বন্ধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করে কিন্তু জনগণ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিতে কিশোর মনু মিয়াসহ ১১ ব্যক্তি নিহত ও শত শত লোক আহন হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা- ৬ দফা আন্দোলন নস্যাৎ করতে না পেরে সরকার ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তাঁরা ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আগরতলায় ষড়যন্ত্র করছিল। আসামীরা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে। কিন্তু স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য তাঁদের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রদের ১১ দফা - ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে প্রচণ্ড গণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত রেখে ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১১ দফা কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিলসহ শিক্ষার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি, জরুরি নিরাপত্তা প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন - আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলনের উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো,' 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর'। এই আন্দোলনের চরম পর্যায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনারও চরম অভিব্যক্তি ঘটে 'জয় বাংলা' শ্লোগান এবং 'তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ' ধ্বনির মাধ্যমে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শুরুর পেছনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভূমিকা অপরিসীম। মাওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন এখান থেকেই। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করে, আহত অবস্থায় বন্দী হন বীর ছাত্ররা। ২০ জানুয়ারি বীর-ছাত্র-যুবক পুলিশ, ই.পি.আর. এর সঙ্গে বীর বিক্রমে লড়াই করেছিল এবং এদেরকে পেছনে হটিয়ে দিয়েছিল। এই আন্দোলনেই আসাদুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস হয়ে উঠে গণ-অভ্যুত্থান দিবস। সেক্রেটারিয়েটের সামনে কিশোর রুস্তম আলী, মকবুল এবং নবম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুর রহমান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন বন্দীদের হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। শেখ মুজিব প্রাণে বেঁচে গেলেও কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক রেহাই পেলেন না। ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয়। সে রাতেই কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই করে। ২২ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচন - প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সনের ২৮ সেপ্টেম্বর এক বেতার-টিভি ভাষণে ১৯৭০ সনের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তাঁর ঘোষণায় তিনি এক ইউনিট ভেঙ্গে দেন, এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি ঘোষণা করেন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কায়েমসহ বেশ কিছু মৌলিক নীতির কথা তুলে ধরেন। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নির্বাচনে তাৎপর্যময় বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনের কিছুদিন আগে ১২ নভেম্বর পূর্ববাংলার দক্ষিণাঞ্চলে স্মরণকালের এক বিপর্যয়কর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকায় দলের পক্ষ থেকে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনের কাজ চালান। এ সময় দুর্গত মানুষের প্রতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অবহেলা ও উপেক্ষায় ক্ষুব্ধ শেখ মুজিব শাহবাগ হোটেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা দেন, ''ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোকের মতো আরো ১০ লাখ প্রাণ দিয়ে হলেও আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আদায় করে নেব।" বৈষম্য - পাকিস্তানের ২৪ বছরে উভয় অঞ্চলের মধ্যে যে বৈষম্য গড়ে উঠে তা যেমন বেদনাদায়ক তেমনি বিস্ময়কর।
মুক্তিযুদ্ধ - বাংলার মানুষের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মপ্রয়াসকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭০-৭১-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলার একক ম্যান্ডেট ও আইনি অধিকার লাভ করেন। নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত আমাদেরকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। চক্রান্ত চলতে থাকে যাতে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় বসতে না পারেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হয়। ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করতে সামরিক বাহিনী ও শাসকগোষ্ঠীর বেসামরিক মুখপাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রকাশ্য বিরোধিতার ফলে পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ কাঠামো ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু তাঁদের মনোভাব বুঝতে পেরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে থাকেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ তিনি রেসকোর্স ময়দানের সুবিশাল জনসভায় ঘোষণা করেন-" এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেল করতে হবে।" ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে চির পদানত করার লক্ষ্যে সঙ্কটের সমাধানে সামরিক চক্রান্ত নিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ওপর রাতের অাঁধারে হামলে পড়ে। পাকিস্তানিদের এই আক্রমণের মোকাবেলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন; ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অবসানে ২৬ মার্চের প্রত্যুষে। শুরু হল আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় সশস্ত্র যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার টিভি ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন - ÔMujib is a traitor to the nation, this time he will not go unpunishedÕ; সমগ্র বাংলাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। এই সংগ্রামকে সুসংবদ্ধ করতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণ-পরিষদ। এ পরিষদের মাধ্যমে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ ৯ মাস বঙ্গবন্ধুর নামে চলে আমাদের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় শেষে আমরা পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করি। ওই দিন রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী বাহিনীসমূহ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ থেকে চিরতরে পাকিস্তানি দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁকে বাদ দিয়ে প্রাক্ ও উত্তর বাংলাদেশের তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের বাঙালির লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রপথিক এবং তিনি গঠনে সহায়তা করেছিলেন বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড, যার নাম 'বাংলাদেশ'। এ জন্য আমরা গর্বিত আমাদের আগামী প্রজন্মও হবে গর্বিত। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে সে জন্যে। আর এ অমরত্বকে আমরা কেবল কবির ভাষাতেই যথার্থ বলে বোধ করতে পারি। "যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।" তথ্যসূত্র - ১/ বাংলাদেশ ও প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস- ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী, ডঃ এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ। ২/ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ - আসাদ চৌধুরী ৩/ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ - মুনতাসীর মামুন ৪/ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক - সিরাজ উদদীন আহমেদ ৫/ মুক্তি সংগ্রাম - আবুল কাসেম ফজলুল হক ৬/ জাতীয় শোক দিবস ২০০৯ বিশেষ ক্রোড় পত্র (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। ৭/ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - মুহম্মদ জাফর ইকবাল ৮/ মুজিবের রক্ত লাল - এম আর আক্তার মুকুল