মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এই অঞ্চলের জনগণের এক বীরত্বগাথা রক্তাক্ত অধ্যায়- যখন স্বাধীনতা অর্জন করেই মানুষ ঘরে ফিরেছে, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। ইতিহাসে এটি এক বিরল স্বাধীনতা লাভের ঘটনা- যার সঙ্গে অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতা লাভের মিল খুব বেশি পাওয়া যায় না। অনেক দেশেই ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, সশস্ত্র পন্থায় যুদ্ধও করেছে। কিন্তু আমাদের মতো আধা ঔপনিবেশিক চরিত্রের পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে, ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে, ১ কোটি মানুষের দেশ ত্যাগ এবং বিপুল সম্পদের ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে এভাবে ৯ মাসের মতো একটানা জনযুদ্ধের মাধ্যমে জয়লাভ করা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পরাজিত করার মতো ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটেনি। তা ছাড়া এই পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মাত্র ২৪ বছর আগে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই পূর্ববাংলার নিরঙ্কুশ জনসাধারণ নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রধান বাধা হিসেবে মনে করেছে, নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরই অর্জন করার চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতা লাভের জন্য বেশিরভাগ মানুষই জীবন উৎসর্গ করতে মাঠে নেমেছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মতো একটি ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে নিজেদের স্বাধীনতাকে চিনিয়ে এনেছে। তবে এই সশস্ত্র যুদ্ধ কোনো সামরিক যুদ্ধ ছিল না- অর্থাৎ দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। বরং এটি ছিল পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর তাৎক্ষণিকভাবে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করা- যা দ্রুত সময়ের মধ্যে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এই যুদ্ধে জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সমর্থন জুগিয়েছে। এই জনগণ স্বাধীনতার জন্য, নিজেদের একটি রাষ্ট্রের জন্য যার যার জীবন উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। ফলে অকাতরে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। হয় স্বাধীনতা নয় প্রাণ- এই স্লোগানে মানুষ রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এভাবে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করার মতো মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ছিল রাজনৈতিক চেতনার উত্থান- যা সৃষ্টি করতে ২৪ বছর রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অনুসারীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছিলেন, মানুষের মধ্যে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ ত্যাগ করার মতো রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করেছিলেন। এই রাজনৈতিক সচেতনতার পেছনে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক চরিত্রকে উন্মোচন করা, পূর্ব বাংলার জনগণকে হেয় চোখে দেখার উদাহরণ তুলে ধরা, পূর্ববাংলার জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার পথপরিক্রমা তৈরি করা। এই কাজটি যে কোনো স্বাধীনতা লাভে ইচ্ছুক জনগোষ্ঠীর অপরিহার্য অর্জন হিসেবে গঠিত হওয়ার পরেই কেবল যে কোনো ঔপনিবেশিক বা আধা-ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, স্বাধীনতা লাভে প্রস্তুত হওয়ার পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করে। পূর্ববাংলায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে স্বাধীনতার পক্ষে ধীরে ধীরে জনমত তৈরি হয়েছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই জনমতকে একটি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরি করেছিল। বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের নিরঙ্কুশ রায় লাভের মাধ্যমে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক প্রস্তুতিকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করার দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তি ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের অনীহার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটালে পূর্ববাংলার মানুষ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। সেই বিস্ফোরিত মানুষকে সুশৃঙ্খলভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন সেটি স্বাধীনতাকামী যে কোনো জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য অসাধারণ নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম, আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সে কারণেই অপারেশন সার্চলাইট নামক গোপন প্রস্তুতি গ্রহণ করেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ববাংলার জনগণের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো তাদের মূল নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, অন্যদের গ্রেপ্তার কিংবা হত্যার উদ্দেশ্যে তাড়া দেয়া ইত্যাদি করেও যে প্রতিরোধের মুখে পড়ে সেটি ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধরে নিয়েছিল ২৫ মার্চ গভীর রাতে অতর্কিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডে পূর্ববাংলা স্তব্ধ হয়ে যাবে, পাকিস্তান টিকে থাকবে। কিন্তু জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন সেটি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আবার প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রতিহত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সেই ঘোষণাই পূর্ববাংলার জনগণের কাছে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, রাস্তাঘাট ধ্বংস করা ইত্যাদিকে প্রতিরোধ করা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার সহযোগীরা স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে শুরু করেন এবং জনগণকে সেই কাতারে শামিল হতে সুযোগ করে দেয়। গঠন করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমর্থনসহ মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার যাবতীয় কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুত করে। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে আমাদের এই রণাঙ্গনের প্রস্তুতির পুরো মাঠ আমরা পেয়েছিলাম প্রতিবেশী ভারতের কয়েকটি রাজ্যের জনগণ ও সেই দেশের সরকারের কাছ থেকে। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকার ও জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আবার কোনো কোনো দেশের সরকার পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল, আমাদের বিরোধিতা করেছিল। এত সব প্রতিকূলতাকে আমাদের তৎকালীন সরকার অতিক্রম করে পূর্ববাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতাকে ক্রমেই বৃদ্ধি করতে পেরেছিল এবং মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে জনগণের কাছে তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক ও কাণ্ডারি। রাজনৈতিক নেতৃত্বও ছিলেন তার প্রতি সম্পূর্ণরূপে অনুগত। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতিকালীন ইতিহাস গড়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন এই স্বাধীনতার মূল রাজনৈতিক নেতা, তার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে জনগণের কাছে প্রধান নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দল। এই দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু এবং তার স্বাধীনতার পথপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভিন্ন শক্তিতে পরিণত হয়। সে কারণেই কঠিন এই যুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ত্যাগ করেনি। বরং তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে সব ধরনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান বাহিনীকে দুর্বল করার মানসিকভাবে ভেঙে দেয়ার সব কাজ সাধারণ নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সমাজের নেতৃত্বদানকারী সবাই যার যার অবস্থান থেকে করেছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য এবং স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা লাভ করার জন্য যে নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তা ছিল এক অভাবনীয় ঐতিহাসিক পর্ব- যখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে লড়ে যাচ্ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পতাকা হাতে বিজয় উৎসব পালন করতে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রমাণ রাখছিল। এ এক বিস্ময়কর মহাজাগরণ। ইতিহাসের এই পর্বটি আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৪৭-পরবর্তী সময় থেকে প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় গোটা ১৯৭১ সালে মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এর আগে বাঙালি এবং অন্যান্য নৃগোষ্ঠী একসঙ্গে এতখানি স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়নি। কিংবা এত আত্মত্যাগ করার জন্য প্রস্তুতও হয়নি। ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তা এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই আত্মত্যাগের মহিমান্বিত এক ইতিহাস। স্বীকার করতেই হবে এই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্র যন্ত্রের পক্ষে ছোট একটি গোষ্ঠী ছিল। যাদের আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বলে জানি এবং এদের রাজনৈতিক মদদদাতা ছিল প্রধানত জামায়াতে ইসলামী এবং অংশত ছিল মুসলিম লীগের কয়েকটি ছোট ছোট গ্রুপ। তবে সম্মিলিতভাবে জামায়াত এবং মুসলিম লীগের শক্তি তখন খুবই দুর্বল ছিল। তাদের মূল খুঁটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের শক্তির অবস্থান বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধের কমবেশি সব দেশেই কিছু কিছু পরিলক্ষিত হয়। তবে স্বাধীনতা লাভের পর এদের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আপনা থেকেই দুর্বল থেকে বিলীন হতে থাকে। স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান খুব কমই ঘটে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়ও সেভাবে ঘটে না। ফলে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর এর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যত সমস্যাই থাকুক না কেন রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ স্বাধীন রাষ্ট্রদ্বয়ের ব্যবস্থার অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে পঠন-পাঠনের মাধ্যমে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীতে গড়ে তোলার চেতনা অব্যাহত রাখে।
দুঃখজনক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য ঘটেছে। এই দেশটি এত ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হওয়ার পরও স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে জানা, বোঝা ও ধারণ করার শিক্ষা নেয়া দরকার ছিল তাতে ঘাটতি দেখা যেতে থাকে। বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সার্বজনীনভাবে দেখেনি। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে এটিকে দেখার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের হঠকারী, উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শিক চিন্তা তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করেছে। বিশেষত যারা বিপ্লববাদে বিশ্বাস করেছে তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ইতিহাসকে জনগণের মুক্তির অপরিহার্য ঘটনা হিসেবে দেখেনি। তারা এই স্বাধীনতাকে পূর্ণাঙ্গ মনে করেনি। তা থেকেই তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের কর্মকাণ্ড ত্যাগ-তিতিক্ষা বিপ্লবীদের কাছে খুব গৌণ হয়ে দেখা দেয়। বিপ্লবীদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ কিনা তা আজো পরিষ্কার নয়। সে কারণেই এদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কিংবা এর পূর্ববর্তী প্রস্তুতি সৃষ্টির ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করেছে। আবার অন্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শ্রেণি ‘শত্রু’ ভারত-রোষের চক্রান্তের নীলনকশা ইত্যাদি চটকদারি মন্তব্যে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছে তা এত ত্যাগের প্রতি তাদের অসম্মানেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরেই এসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশে উগ্র হঠকারী বাম রাজনীতির নামে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টির ইন্ধনদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে। এদের ছাড়াও আরো অনেকেই যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে উগ্র-হঠকারী রাজনীতির ধারাতে দেশের উঠতি তরুণ সমাজের একটি অংশকে কাছে টানার মতো নানা চটকদারি বিপ্লবীতত্ত্ব প্রচার করেছে, নানা সংগঠন গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ১৯৭১ সালে যে প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭২ সাল থেকে তাতে বিভাজন সৃষ্টির অপরাজনীতি তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি জলাঞ্জলি দানের রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ প্রকাশ্যে ঘটতে থাকে। নতুনভাবে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারীদের রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধও তখন থেকে ক্রমেই জনচেতনা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ভাবাদর্শ তৈরি করা হয় যেখানে মুক্তিযুুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শের বিপরীতে বাংলাদেশের বিকৃত কিছু আদর্শ সৃষ্টি করা হয়, যার একটি হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অন্যটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো। সেই থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামরিক নেতৃত্বের লড়াই হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশে আমদানি করা হয় স্বাধীনতার ঘোষক পদটি। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ (১৯৭৫) এবং পঞ্চম (১৯৭৯) সংশোধনীতে ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ গৃহীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ দলিলটি হুবহু অবিকৃতভাবে রাখা হয়েছে। সেখানেই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কীভাবে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কারো পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার অধিকার ছিল না। সেটি দেয়াও হয়নি। হলে সেই দলিলেই লেখা থাকত। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য জানার পরও বাংলাদেশে একটি বড় রাজনৈতিক দল এবং এর সমর্থকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে বিকৃত করার হীন উদ্যোগ ক্রমাগতভাবে নিয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণার বঙ্গবন্ধুর প্রথম বার্তাটি মূল দলিলপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়, অন্তর্ভুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমান নামে একটি জাল দলিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা কটূক্তি করতেও দ্বিধা করা হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত এক সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ চাননি। সে কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এমন বক্তব্য বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাসী কমবেশি প্রায় সবাই ২০০১-২০০৬ সালে করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নানা কটূক্তি করতে আমরা বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখেছি। তারা আবিষ্কার করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ নাকি তার ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে। বস্তুত বিএনপির মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যখন মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাসকে অস্বীকার করে, নানা বানোয়াট কথাবার্তা বলে ইতিহাসকে খেলো করে ফেলে তখন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের অসম্মান ও অশ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে- এটি তারা বুঝতে চান না।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল ছিল। তারা কোনোকালেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্বীকার করতে চায়নি। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতেই ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে দেখেছে। জিয়াউর রহমান কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী দেশে রাজনীতি করার অধিকার পাওয়ার পর তারা মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শের বিরুদ্ধে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছে। তাদের নেতাকর্মীরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক বিশ্বাসের আদলেই দেখেছে এবং এখনো বিশ্বাস সেভাবেই করে। সুতরাং মুখে জামায়াত যতই বলুক তারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি তাদের সমর্থনের কোনো উদাহরণ এখন পর্যন্ত তারা দেখাতে পারেনি। তাদের নেতাকর্মীদের কেউই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকাকে স্বীকার করেনি। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করে না। ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং অন্য বিষয়গুলো তারা ১৯৭১ সালে ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখে না।
আমাদের দেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যাপ ও সিপিবি মুক্তিযুদ্ধে একনিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা এই ইতিহাসকে সম্মানের চোখে দেখেন। কিন্তু বর্তমানে বাম ঘরানার বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে সেভাবে সোচ্চার নয়। কিংবা এর বিকৃতকারী রাজনৈতিক শক্তির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছেন না। অথচ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির একটি বিরাট শক্তি দেশের গণতন্ত্রের শক্তি হিসেবে দাবিদার কিংবা অনেকের কাছে অংশীদার। বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি তাদের আস্থার সুযোগ রাখেনি। যারা সেই সুযোগ রাখেনি তারা উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সত্যি হওয়ার কোনো কারণ নেই। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান বাম রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর রাজনীতির প্রতিষ্ঠায় কতটা দৃঢ় অবস্থান পোষণ করে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এ ধরনের নানা বাস্তবতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অভিন্ন, এর চর্চাও হতে হবে ইতিহাস সম্মতভাবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।