(পূর্ব প্রকাশের পর)
আওয়ামী লীগ ও দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ (১৯৭১) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে এক ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ তাতে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করে। কয়েক দিন পর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে তৈরি থাকার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র বাঙালী জনগণের ওপর পাকিস্তানী সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণের ফলে কার্যত পাকিস্তানের অখ-তা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ১২ এপ্রিল অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং ১৭ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সঠিক একটি প্রবাসী সরকার (মুজিবনগর সরকার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামল : বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের ‘জনক’ অভিধায় ভূষিত হন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো এবং বিশ্বের ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল আওয়ামী লীগের অপর একটি সাফল্য। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত নতুন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল না বলেই চলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষুধাপীড়িত একটি জাতিকে আপন শক্তিতে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ প্রায় চার বছর তিনি প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেন। এরই মধ্যে কিছু নেতিবাচক ঘটনারও অবতারণা হয়। এ সময় কিছু অসন্তুষ্ট জুনিয়র পর্যায়ের সামরিক অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের চার শীর্ষনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যার ফলে আওয়ামী লীগের ওপর আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসে।
ক্রান্তিকাল : ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই ক’বছর আওয়ামী লীগের ইতিহাসে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে। ১৯৭৫ সালে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে এবং জাতীয় চার নেতাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে আওয়ামী লীগের ধ্বংসসাধনে প্রবৃত্ত হয়। বস্তুত ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে। অধিকন্তু সামরিক সরকার কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল প্রবিধানের আওতায় এ দলটি পুনরুজ্জীবিত (১৯৭৬) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। সামরিক সরকারের নেপথ্য প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগকে বহুধাবিভক্ত করা হয়। ব্যাপক নেতৃত্ব-কোন্দল ও অনৈক্য দেখে অনেকেই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব : বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের মূল অংশের (আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন) বেশ কয়েক নেতা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন ছিলেন অন্যতম। ১৯৮১ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী নির্বাচন করা হয়। এ সময় তিনি ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের অনুরোধে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে। এ দল ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩৯টি, ১৯৮৬ সালে ৭৬টি এবং ১৯৯১ সালে ৮৮টি আসন পায়।
১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমে বিরোধীদলীয় নেত্রী নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে সমাসীন হন। ১৯৯১ সালেও তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেন। এ সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ও অবিরাম আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন করে, তারপর সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং ক্রমাগত হরতাল আহ্বান করে। এসব প্রয়াসের ফলে বিএনপি সরকার শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে’র জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনয়ন করে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন লাভ করে এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ তারিখে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যেসব সাফল্য অর্জন করে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি (১৯৯৬) স্বাক্ষর, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) সম্পাদন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিলাদের সরাসরি অংশগ্রহণের ব্যবস্থাসহ নারীর ক্ষমতায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিরোধীদলীয় আসনে জাতীয় সংসদে যোগাযোগ করে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংগ্রাম ও সাফল্যের ৬০ বছর পূর্তি (হীরকজয়ন্তী) উদযাপন করে। এ সময় দলনেত্রী শেখ হাসিনা ‘দিনবদলের’ জন্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। শেখ হাসিনা ‘দিনবদলের নেত্রী’ অভিধায় ভূষিত হন। আওয়ামী লীগের প্রতি দেশের আপামর গণমানুষের আস্থাশীলতা সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগের ওপর শাসকগোষ্ঠীর প্রথম আক্রমণ
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর পরই দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর শুরু করেন। সর্বত্র দলটির প্রতি জনগণের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করেন তিনি। যেখানেই গেছেন তিনি সেখানেই জনগণ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে, সংবর্ধনা প্রদান করেছে এবং দলে দলে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে সমবেত হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি জনতার এত আগ্রহ শাসক দল মুসলিম লীগকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
২৫ আগস্ট মওলানা ভাসানীর চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে সেখানে তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা দেয়া হয়। হাজার হাজার মানুষ রেলস্টেশনে এসে মওলানাকে সংবর্ধিত করেন। সেদিন বিকেলে জেএম সেন হলে আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানীর আগমনে কর্মী সম্মেলনটি জনসভায় পরিণত হয়। মওলানা ভাসানী সেদিনের জনতার উদ্দেশে বেশ কিছু সুন্দর কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ মানুষের ভাই, মানুষ মানুষের প্রভু হতে পারে না, আল্লাহই একমাত্র প্রভু” (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮)।
মুসলিম লীগের প্রতি হতাশ হয়ে সর্বস্তরের মানুষ যখন আওয়ামী লীগের দিকে ধাবিত হতে শুরু করলেন, তা রোধ করার কোন ক্ষমতাই যখন শাসকগোষ্ঠীর হাতে ছিল না, তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে কোন ছলছুতায় গ্রেফতারের ফন্দি আঁটে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার। কিন্তু নানা রকমের বাধা-বিপত্তি আর শত অত্যাচার সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ববাংলার প্রতিটি জেলাতে বিরাট কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তারা কর্মীদের বোঝালেন কিভাবে পূর্ববাংলায় অত্যন্ত দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হতে চলেছে।...মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব প্রতিটি ব্যাপারেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলেন। ...মওলানা ভাসানী-মুজিব উল্কার মতো বাংলার পথেপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। তৎকালীন বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা হলো (সূত্র : পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ভাসানী-মুজিবের রাজনীতি, কৃত-এম আর আখতার মুকুল, ঢাকা পাবলিশার্স, ১৯৮৭ : পৃ. ১৭)। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। তিনি এখানে গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন এলাকায়) ওঠেন। এ সময় জাতীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও জনগণের দাবি লিয়াকত আলী খানের নিকট তুলে ধরার জন্য ১৩ অক্টোবর আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী লীগ সমাবেশের ডাক দেয়। সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ এ সমাবেশে যোগ দেন। দ্রব্যমূল্য ও খাদ্যাভাবের বিষয় নিয়ে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে সভায় বক্তব্য রাখা হয়।
‘কিন্তু বক্তৃতার পালার শুরুতেই ... প্রথম বক্তার বক্তৃতা শুরু করার সাথে সাথে মাঠের পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় দিক হতে একটা হই চই রবের সৃষ্টি করা হয়। তাতে সভায় উপস্থিত মানুষের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার হয়।