বঙ্গবন্ধুর গৌরবময় শাসন ও উন্নয়ন


সুজিত সরকার

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সবচেয়ে গৌরবময় কীর্তি একটি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্নে মোহিত করা এবং সেই আলোকে তাদের সংগঠিত করে সশস্ত্র লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা। এ দেশে অনেক নেতা জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো ধী-শক্তি সম্পন্ন নেতার সাক্ষাৎ জাতি আর পায়নি। তিনি তাই প্রাতঃস্মরণীয় ও নমস্য।
এ কথা সত্যি যে, মানুষ আমৃত্যু নির্ভুল নয়। যে কাজ করে তার ভুল হয়। যে করে না সে কেবল পারে ভুল ধরতে, পারে গঠনমূলক নয়, বিরূপ সমালোচনা করতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঠে যারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজতন্ত্রজ্জতা-ও আবার ‘ধর্মীয় বিধান’ মতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে জনতার স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিপথগামী এবং বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, তারা ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী আর বাস্তবতা বর্জিত অপরাজনীতিক। তাদের সকল চেষ্টাকে বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ করে নিজ মেধা ও শক্তিতে জাতিকে সংগঠিত করে যুদ্ধের মাঠে অবতীর্ণ করতে সক্ষম হন। এই প্রজ্ঞা সাড়ে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সী একজন ব্যক্তি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনতার সংগ্রামকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি শাসকেরা অনুমান করতে ভুল করেনি যে, এই মানুষটিই তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাবেন। একেই কারারুদ্ধ করো। শেষে মিথ্যে মামলায় ফাঁসি দিতে তারা সকল আয়োজন পূর্ণ করেছিলো। কিন্তু বাঙালির দুর্বার সংগ্রাম তাদের সকল ষড়যন্ত্র মিথ্যে প্রতিপন্ন করে দেয়। বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হন এবং নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানিরা ঘুমন্ত-নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণ চালালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং সমগ্র জাতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। তখন তাঁর সমান্তরালে আর কোনো নেতা ছিলেন না। তাদের কারো ডাকে একটি সুসংগঠিত প্রতিবাদী মিছিল-মিটিংও হয়নি। যা হয়েছে, তা সাময়িক। লোক দেখানো। তেইশ বছরের সংগ্রামের পথ বেয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ জাতিকে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেন,‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
জাতি সত্যিই তাই করেছে। কেউ সরাসরি অস্ত্র ধরে, কেউ যোদ্ধাদের আশ্রয়-পরামর্শ দিয়ে, কেউ খাদ্য-অর্থ দিয়ে  কেউ সংগঠিত করে নিঃশর্তভাবে সহযোগিতা করেছে। তার জন্যে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্নে আত্মাহুতি দিয়েছেন। সাড়ে চার লক্ষ মা-বোন সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন। এই সব ত্যাগ-বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে জাতি পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর অপরাপর জাতির মতো যারা সংগ্রাম করে জাতিকে শোষণ-দুঃশাসন মুক্ত করেছেন, তাদের মতোই নানা সমস্যায় নিমজ্জিত হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশের সমুদয় সম্পদ লুটপাট করে তাদের দেশে নিয়ে যায়। কল-কারখানা, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-বাজার ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে জনপদের প্রতিটি ঠিকানা। লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করে জনজীবনের স্বচ্ছ্বলতা কেড়ে নেয়। বিজয় অর্জন পর দেশ ছিলো কর্পদকহীন। কোষাগারে নেই অর্থ, গুদামে নেই মজুদ খাদ্য। মানুষ খাদ্যাভাবে বিপর্যস্ত। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিতে সরকার পরিচালনা করতে শুরু করলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর উন্নয়নসহ সামাজিক বিচ্ছৃঙ্খলা বন্ধ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। বিনা টাকায় প্রাথমিক শিক্ষা ও বই দেয়া, বকেয়া খাজনা মওকুফ এবং যাদের জমি ২৫ বিঘার নিচে তাদেরও খাজনা মওকুফ করেন। ১০ লক্ষ সার্টিটিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেন।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে শেষ বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘…আপনাদের মনে আছে, পাকিস্তানিরা যাওয়ার পূর্বে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, সম্পদ ধ্বংস করব, বাঙালি স্বাধীনতা পেলেও যেন এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে না পারে। তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাঙ্কে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম, দেশের ভার নিলাম, তখন দেশের রাস্তাঘাট যে অবস্থায় পেলাম, তাকে রিপেয়ার করবার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনি নাই, প্রায় ধ্বংস করে গেছে। পুলিশ বাহিনির রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভাল করতে কী করি নাই? আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না। আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না, বৈদেশিক ডিপার্টমেন্ট ছিল না, প্ল¬্যানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হল। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানিরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভের কোন অংশ আমাকে দিল না। একখানা জাহাজও আমাকে দিল না। একখানা প্লে¬নও আমাকে দিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ আমাকে এক পয়সাও দিল না। এবং যাওয়ার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলো, রাস্তা ধ্বংস করলো, রেলওয়ে ধ্বংস করলো, জাহাজ ডুবিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের শেষ জনসভা ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ। সেই ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন পাকিস্তানিদের দ্বারা বাংলার সম্পদ ধ্বংস করা এবং যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশের বিপন্ন অর্থনীতির বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শত জটিলতা, স্বাধীনতা বিরোধীদের গোপনে বসে নাশকতামূলক কার্যকলাপ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং নানাবিদ প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এই ধ্বংসযজ্ঞ সামাল দিতে সময় লাগবে। সে পর্যন্ত জাতির সহযোগিতা চাই।’ বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যে এনে দেন। অথচ কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল সম্পর্কে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করেছে। তবে বর্তমানে প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতির সার্বিক ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন।
তিনি কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেন। সেচ প্রকল্প, সার, উন্নত বীজ, কীটনাশক, সারসহ কৃষি উপকরণ কম মূল্যে বিক্রির নির্দেশ দেন। লো-লিফ্ট পাম্প এব গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ২,৯০০ ও ৩,০০০টি। ফলে  দেশের খাদ্য ঘাটতি অনেকটাই কমে আসে। পঁচাত্তরে পাকিস্তান শাসনামলের চেয়ে ভূমিহীনের সংখ্যাও কমে আসে। নাশকতা সত্ত্বেও শিল্প ক্ষেত্রেও ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৪-৭৫-এ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ১২ শতাংশ। সূতা ও বস্ত্র উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জিত হয়। এ ছাড়া, খাদ্যশস্য, নিউজপ্রিন্ট, চা, সাইকেল, বৈদ্যুতিক তার ও তামার তারের উৎপাদন পূর্বেও বছরের থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্যও হ্রাস পায়। ১৯৭৪-এ সারা বিশ্বে মুদ্রস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে। তার প্রভাব সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও পড়ে। ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে আর্জেন্টিনায় ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় ১১ শতাংশ, কোরিয়ায় পূর্বের মূল্যের চেয়ে তিন গুণ বেশি, ইংল্যান্ডে দ্বিগুণ। ১৯৭৪ সালে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ। ঢাকায় ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে মোটা সিদ্ধ চালের প্রতি সেরের মূল্য ছিলো ৪ টাকা, অক্টোবরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে এই মূল্য কমে সের প্রতি ৬ টাকায় নেমে আসে। ১৪ আগস্ট ’৭৫-এ এসে দাঁড়ায় ৩.৭৫ পয়সা। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই সময়ে ঢাকা শহরে চালসহ সকল প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রমেই কমতে থাকে।
বন্যা, বিশ্বাসঘাতকতা, ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাংক লুট, শ্রেণিশত্রু খতমের নামে আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা, অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাচ্ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে। ভাবতে অবাক লাগে যে, এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি কাজগুলো গুছিয়ে নিয়েছিলেন। পুনর্গঠনের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তা জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্সের বেলায় ঘটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওই সব দেশে, কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবুও তারা ৫ বছরের মধ্যে কোনো অতিরিক্ত দাবি-দাওয়া বরদাস্ত করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকা ৫ বছর পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মচারীর বেতন বাড়ায়নি। রাশিয়া ও চিনের বিপ্ল¬বের পর অনাহারে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মৃতের সংখ্যা সে তুলনায় নগণ্য। তবুও সে সময় ‘সাপ্তাহিক হলি ডে’সহ কয়েকটি পত্রিকা মিথ্যে তথ্য প্রচার করে, যেমন এক কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক বাকশক্তিহীন অপ্রকৃতিস্থ  নারীকে জাল পড়িয়ে ছবি তুলে তারসহ দেশের দুরাবস্থার চিত্র সংবাদপত্রে পরিবেশন করে জনমনে বঙ্গবন্ধু সরকার সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরির অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু আদৌ কি তখন সে অবস্থা বিরাজ করছিলো? সদ্য স্বাধীন কোষাগার শূন্য দেশে তাদের দাবি-দাওয়ার অন্ত ছিলো না। অবিকল অন্ত ছিলো না বঙ্গবন্ধু সরকারের ভুল-ভান্তি নির্দেশের সীমা। তারা পক্ষান্তরে পাকিস্তান আর যে চিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো, তাদের পক্ষে অপ-প্রচার আর অপকর্ম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। একই সঙ্গে জনমানসেও তারা দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরোধী বিষবৃক্ষ রোপণেও অত্যন্ত তৎপর ছিলো। বঙ্গবন্ধু হত্যা পর সে কারণে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়নি। অবশ্য সে সময়ের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। অনেকে ছিলেন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে এরাও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু সকল প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে ১১ হাজার কোটি টাকার ধ্বংসস্তুপের পর আরো ১৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন স্তম্ভ দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, কমনওয়েল্থ এবং ওআইসি সহ ১৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ, ২২১টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, শিল্পোৎপাদন ও কৃষি উৎপাদনে ভারসাম্য এনে দিয়েছিলেন। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি দেখে বিশ্ব অবাক হয়েছিলো। এই তথ্য জেনে ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ তিনি সত্যিকারেই হিমালয় সমতুল্য এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। তবে ক্যাস্ট্রো তাঁকে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী সেনাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওরা পরাজিত শক্তিরই পৃষ্ঠপোষকতা করবে। প্রতিবিপ্লবীদের নানা আঙ্গিকে সহযোগিতা দেবে। দিয়েছিলোও তাই। ফলে তাদের ষড়যন্ত্রেই তিনি সপরিবার নিহত হন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে।
তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ১৯৭৪-৭৫ সালের বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয় যাজ্জ১৯৭৩-৭৪ সালে চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। এর আগে উৎপাদন হয় ৩৪ লাখ টন খাদ্যশস্য। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ সময়ই তার ওপর পরিকল্পনা মোতাবেক চূড়ান্ত আঘাত হানা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিনবছর সময় পেয়েছেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকা-কে পরিচালিত করেছেন দু’টি ভাগে। প্রথমতঃ পুনবার্সন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়তঃ উন্নয়ন। এ সময়ের মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১৮৫১টি রেল ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪০৬টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ও ৩টি পুরোনো বিমানবন্দর চালু করে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া মাইন উদ্ধার ও সংস্কার করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর চালু করা হয়। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বিমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিট জাতীয়করণ ও উৎপাদনক্ষম করে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন, মদ-জুয়া, হাউজি-ঘোড়াদৌড়সহ সমস্ত ইসলাম বিরোধী কর্মকা- নিষিদ্ধকরণ, ইসলামি ফাউন্ডেশন গঠন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, পবিত্র হজ্ব পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, ওআইসি সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপে। আজকের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অনেক শহর-গ্রামে এ দুষ্কর্মগুলো পরিচালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা বিরোধী এই আত্মহননমূলক কাজ থেকে মুক্ত হতে না পারলে দেশটা আবার দেশবিরোধীদের করতলে বন্দি হবে এবং তখন আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেজ্জযা কল্পনারও অতীত।
এই তথ্য পড়েও কেউ যদি মনে করে, বঙ্গবন্ধু সরকার ব্যর্থ, তাহলে বলতেই হয় সে কেবল খোদ রাজাকারের অপ-ভাষ্য এবং যারা দেশবিরোধী রাজাকার মানসিকতা ধারণ করে কেবল তাদের মুখেই এ সব মিথ্যেচার শোভা পায়। সুস্থ এবং দেশপ্রেমিক কেউ প্রলাপ বকবে না। এই মহান মানুষটিকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতার চেতনা ও আদর্শকে বিপর্যস্ত করেছে সামরিক স্বৈরাচার এবং দেশের উন্নয়নকেও চরমভাবে ব্যাহত করেছে। যারা এই খুনের সঙ্গে যুক্ত এবং খুনের সমর্থক তারা সমভাবে অপরাধী, দেশবিরোধী এবং স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক আর একাত্তরের ঘাতক-দালালদের উপাসক। তাদের প্রতিরোধের মধ্যে দিয়েই কেবল দেশের উন্নয়ন সম্ভব এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন সফল হবে।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার : লেখাটির সমুদয় তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কন্সালটেন্ট ড. এম. আব্দুল্লাহ্র ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর : যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও সাফল্য’ শিরোনামের রচনা থেকে।]

SUMMARY

2103-B7.jpg