বঙ্গবন্ধুও একত্রে জাতীয়করণের হিসেব চেয়েছিলেন


অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী 
বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ে আর কতো লিখব ? লিখতে লিখতে কলম ভোঁতা! কে শুনে কার চিৎকার ? কে বুঝে কার কষ্ট ? যার জ্বালা কেবল সে-ই জানে। আর তো কেউ উপলব্ধি পর্যন্ত করে না।

আমার এ লেখালেখি নিয়ে নানা জনের নানা মন্তব্য । কেউ পজিটিভ আর কেউ নেগেটিভ। কিন্তু, আমি একটা ব্যক্তিগত দায়বোধ থেকে লিখে থাকি । আমি শিক্ষা, শিক্ষকের এবং শিক্ষার্থীর জন্য লিখি । আমি প্রজন্মের জন্য লিখি। আমি বিবেকের তাড়নায় লিখি। শিক্ষার উন্নত পরিবেশ ও শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য লিখি । সে ভাবনাগুলো একান্ত আমার নিজের। কারো ভিন্নমত থাকতেই পারে।

একটা জাতিকে জীবিত রাখতে শিক্ষা যেমন অপরিহার্য, তেমনি শিক্ষাকে চলমান রাখতে শিক্ষককে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে শিক্ষককে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস আমরা কতটুকু প্রত্যক্ষ করি ? সে প্রয়াস নেই বলে আমাদের শিক্ষায় আজ নানা দূর্গতি। আজ আমাদের সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব প্রকট।


আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে কতো কথা হয়। শিক্ষিত হয়ে ও অনেকে দূর্নীতিতে হাবুডুবু খায়। নৈতিক মূল্যবোধের একেবারে নীচের সিঁড়িতে আমরা।দলে দলে পরীক্ষা পাশ করে কেবলি বেকারত্বের সারিটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করি। লেখাপড়া করে বড় হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ খবর রাখার গরজ হারিয়ে ফেলি।অতি সম্প্রতি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কতিপয় তরুণ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে ।

আজকাল স্কুল-কলেজে যাবার পথে আমাদের অনেক ছেলেপেলে বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বিদের সালাম কালাম করে না।অবলা খাদিজারা লম্পট বদরুলদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার। খাদিজারা আমাদের মা, আমাদের ভগিনী।এ মা ও ভগিনীরা আজ আমাদের কাছেই নিরাপদ নয়।

কোথায় চলেছি আমরা? আমাদের গন্তব্য কোথায়? এই কুলাঙ্গার বদরুলগুলো আমাদের শিক্ষাঙ্গনের আগাছা। আমাদের শিক্ষার গ্যাপ কোথায় ? সেটুকু আমাদেরই খোঁজে বের করতে হবে ।

আমাদের সমাজে শিক্ষকদের সম্মান আজ কেবল কাগজে-কলমে আর বক্তৃতা-ভাষণে।শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।শিক্ষক মানুষ গড়ার শিল্পী।জাতি গঠনের কারিগর।সত্যি তাই।কিন্তু, আমাদের এ সমাজ আজ শিক্ষকদের কোন চোখে দেখে ?

আজকাল অনেকে নিজের ছেলে কিংবা মেয়েকে কোনো শিক্ষক পাত্র অথবা পাত্রীর কাছে বিয়ে দিতে পর্যন্ত রাজী হয় না। সভা-সেমিনার কিংবা কোন অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষক কতটুকু মর্যাদা পান ? দর্শক সারিটা বড়ো করার জন্য কখনো কখনো শিক্ষকদের ডেকে নেয়া হয়।অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ, প্রশাসনিক আমলা কিংবা রাজনীতিকদের ঠেলায় শিক্ষকরা কোণঠাসা।

বাস্তবতা নিঃসন্দেহে বড়ই দুঃখজনক।বর্তমান সময়ে ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে বেশির ভাগই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ অফিসার কিংবা অন্য কিছু হবার কথা লিখে।শিক্ষক হবার কথা ক’জনে লিখে ? বি,সি,এস-এ আজকাল প্রশাসন, বিচার, পররাষ্ট্র, পুলিশ কিংবা স্বরাষ্ট্র ইত্যাদি ক্যাডার সবার পছন্দ।

যারাই বিসিএস-এ অবতীর্ণ হন তাদের প্রথম নয়, শেষ চয়েস থাকে শিক্ষা ক্যাডার।এখন অনেক শিক্ষকও চান না, বড় হয়ে তার সন্তান শিক্ষক হউক।

অবশ্য ইদানিং একটা জিনিসের উন্নতি হয়েছে।এখন আর কেউ শিক্ষকদের ‘মাস্টর’ বলে অভিহিত করে না। ‘স্যার’ বলেই ডাকে।সে একটা ইতিবাচক দিক।এক সময় সম্মান ও শ্রদ্ধা ভরে শিক্ষকদের ‘মাস্টর সাব’ বলে ডাকা হতো।পরে তা ‘মাস্টর’-এ নেমে আসে ।

আমাদের সন্তানরা পড়াশুনায় মনযোগী নয় কেন ? অনেকে পাঠ্যবই ক্লাস শেষে ডেক্সের নীচে ফেলে রেখে বাড়ি চলে যায়।নোট- গাইড আজ তাদের মূল অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী খুব মনযোগী। কোনো কোনো শিক্ষক একেবারে কোচিংয়ে দিনরাত ডুবে থাকতে পছন্দ করেন।

অনেক ছেলেপেলে আজকাল চুল-দাঁড়ি নিয়ে কতো রংঢং তামাশা করে।দাঁড়ি কিংবা চুল কাটার ধরণ দেখে মেজাজ একেবারে নষ্ট হবার উপক্রম।এ সব দেখে বড়দের যেন মন খারাপ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।মোবাইল ও ইন্টারনেট পিচ্চি বাচ্চাদের পর্যন্ত খেয়ে ফেলছে ।

তাদের এক-আধটু শাসন করার অধিকার শিক্ষকেদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।শাসন আর শাস্তি এক জিনিস নয়। সোহাগ ও আদর মিশ্রিত শাসন ছাড়া সন্তান মানুষ হয় কী করে ?

এখন শিক্ষক কোনোভাবেই শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারবেন না। কোনদিন জানি বলা হয়, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কোনোভাবে আর আদর ও করতে পারবেন না! এভাবে কী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না ? কী মধুর সম্পর্ক ছিল ছাত্র ও শিক্ষকের !

আসল কথার খেই হারিয়ে অনেক দূর চলে এসেছি।ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে । যেটুকু আজ বলতে চাই, গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণে কত টাকা অতিরিক্ত লাগে তা সাবেক শিক্ষাসচিব এনআই খান খ্যাত নজরুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন।

ইতিপূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এত জনপ্রিয় আর কোনো শিক্ষাসচিব এসেছিলেন কিনা, জানা নেই । মাননীয় প্রধানমন্ত্রির এ কথায় সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ যে আশার আলো দেখেছিলেন, আজো তারা সে আস্থা ও বিশ্বাসটুকু বুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে শিক্ষার বিস্তার ও প্রসারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।এনআই খান সাহেব সে হিসেবটা করেছিলেন কিনা কিংবা করে থাকলে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রিকে জানিয়েছিলেন কী না- সেটুকু জানা হয়নি ।

অনেক প্রবীন শিক্ষকের মুখে শুনেছি, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউছুফ আলী সাহেবের কাছে এ রকম একটা হিসাব জানতে চেয়েছিলেন।

এক অগ্নিময় ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন, তখন মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের একটি শিক্ষক প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে একই সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরকে ও জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউছুফ আলী সাহেবকে ডেকে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণে কত টাকা লাগে তা হিসেব করে জানাতে বলেছিলেন এবং শিক্ষক প্রতিনিধি দলকে আরো ক’টা দিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

এক বিশ্বমাপের নেতা বলেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে ও বঙ্গবন্ধু এরূপ আশার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন, শিক্ষকদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন।

আমরা জানি না ইউছুফ আলী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে সে হিসেব দিয়েছিলেন কী না ? তবে, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন।দুর্বৃত্তরা বঙ্গবন্ধুকে সে সময়টুকু দেয়নি।সময় পেলে তিনি নিশ্চয় এতোদিনে বহু আগেই প্রাথমিকের মত মাধ্যমিক স্তর ও জাতীয়করণ করে যেতেন ।

আজ আর জাতীয়করণ, জাতীয়করণ বলে চেঁচাতে হতো না ।

বঙ্গবন্ধু কতো বড় মানের ও বিশ্ব মাপের দূরদর্শি নেতা ছিলেন; সে এখন কোনো গবেষণার বিষয় নয়, বাস্তবে প্রমাণিত ধ্রুব এক সত্য কথা।তিনি সেদিন একত্রে মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের গুরুত্ব নিশ্চয় অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলে তাঁর মতামত সে ভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের জাতির জনক বেঁচে নেই।কিন্তু, আমাদের সৌভাগ্য যে, তাঁরই তনয়া শেখ হাসিনার হাত ধরে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে।তাঁর চিন্তা, চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর অঙ্গিকার বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গিকারাবদ্ধ ।

জাতির জনক ও তাঁর তনয়ার চিন্তা, চেতনা ও আদর্শ আজ একাকার।স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের বিষয়ে আমরা উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি সমান ও সমান্তরাল দেখতে পাই।

জাতীয়করণের সুফল অনেক।কোচিং ও নোট-গাইডের দুর্নাম থেকে কেবল জাতীয়করণই আমাদের বাঁচাতে পারে।নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ আমরা এর মাধ্যমে ফিরে পেতে পারি।শিক্ষার গুণগত মানের মৌলিক পরিবর্তনের দ্বারা প্রত্যাশা করা যায়।

মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক পাবার সমূহ সুযোগ সৃষ্টি ও স্কুল-কলেজে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এভাবেই সম্ভব ।

জাতির জনক ও জননেত্রী শেখ হাসিনার অভিন্ন চিন্তার আলোকে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতি পূরণে সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করা বর্তমান সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে সকলে মনে করেন। শিগগিরই তারা সে দায়িত্বটুকু পালন করবেন; তা সমগ্র জাতির প্রত্যাশা।

জাতীয়করণে সরকারের কোনো লোকসান বা ঘাটতির আশংকা নেই। কেননা, এখানে আর্থিক দায়-দেনার বিষয়টি এতোদিনে অনেক কমে এসেছে।টাকাকড়ির সংস্থানও আছে অনেক । প্রয়োজন কেবল সময়োপযোগি সিদ্ধান্তটি ঘোষণা ও বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনা।

তাহলে উন্নয়নের মহাসড়কে আমরা এগিয়ে যাবো আরো যোজন যোজন কিলোমিটার পথ।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিয়মিত কলাম লেখক ।

SUMMARY

2102-1.jpg