বাহালুল মজনুন চুন্নু
শিক্ষা বিনিয়োগ, শিক্ষা মৌলিক অধিকার। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ছাব্বিশ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সংবিধানেই শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের পনেরো ও সতেরো নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে।
শিক্ষার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়ে সত্তরের নির্বাচনী ভাষণে জাতির পিতা বলেন, সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর সেদিনের ভাষণে শিক্ষাকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল তাঁর বই পড়ার অভ্যাস। তিনি বিশ্বাস করতেন, বই মানুষের চেতনাকে শাণিত করে। ছাত্রাবস্থায় এমনকি জেলে বসে তাঁর একান্ত ও বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল বই। তাঁর জ্ঞানার্জনের আগ্রহ ছিল বিস্তৃত। জ্ঞানপিপাসু জ্ঞানতাপস বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কীভাবে জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত করে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার পাঁয়তারা করেছিল, কীভাবে সুকৌশলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনছিল। সাতচল্লিশ সালে পূর্ববাংলায় যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২৯৬৬৩ টি, সেখানে আটষট্টি সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ২৮৩০৮ টি। মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও বিদ্যমান ছিল প্রকট বৈষম্য। তদুপরি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের শতকরা ষাট ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য বাহাত্তরের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একান্ন কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। বাহাত্তরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা’র ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে তিন কোটি বাহাত্তর লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষাখাতে। গণশিক্ষার প্রসারে অর্থাত্ নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বরাদ্দ করেছিলেন আড়াই কোটি টাকা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল নারীশিক্ষা অগ্রযাত্রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে তাঁর দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ ছিল ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা। সেটা তিনি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করে তুলবে, এজন্য তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে বৃত্তিমূলক
শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য তাঁর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত-বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যা মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথকে সুগম করেছিল। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, দর্শন এবং শিক্ষার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর নির্দেশে প্রণীত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উপর ভিত্তি করে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল কমিশন। কমিশন শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, যেমন-মোট জাতীয় আয়ের সাত ভাগ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, পাঁচ বছরের মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করা, শিক্ষকের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষকের বৈষম্য দূর করা, নারী শিক্ষার প্রসার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ, শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তন, পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় গবেষণাসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলো করা হয়েছিল জাতীয় আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে। বঙ্গবন্ধু কমিশনের রিপোর্টটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। এবং তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।
কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সময় প্রণীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ১৬.৮ শতাংশের সাক্ষরতার হার এখন পৌঁছেছে ৭১ শতাংশে। প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হার ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারী শিক্ষার হার ৭৪%-এ উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় সর্বাগ্রে পরিমাণগত উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে, আর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে গুণগত উন্নয়নের দিকে। এজন্য শিক্ষায় ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে।
লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।