মো. সিদ্দিকুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। গরীব প্রাথমিক শিক্ষক ও এদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের মর্যাদা পায় প্রায় দেড় লাখ প্রাথমিক শিক্ষক।
স্বাধীনতার পর সর্বত্র ছিল শুধু অভাব আর অভাব। অন্ন, বস্ত্র, শিশু খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট। রাস্তাঘাট, পুল, রেলপথ, গাড়ি, বাড়িঘর প্রায় সবই ধ্বংসস্তুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার ছিল শূন্য। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা পাটের গুদামসহ মূল্যবান স্থাপনায় প্রতিনিয়ত আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সংকট দূরীকরণে রেশনকার্ড, ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করছেন। কারফিউ দিয়ে তখনকার রেশনকার্ডের দুর্নীতি রোধ করছেন। এ ভয়াবহ আর্থিক সংকটে যেখানে দেশ ছিল বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরশীল।
বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এ দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষিত করতে না পারলে দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। এ মহামানব তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্বাস থেকে শূন্য হাতে ঘোষণা দেন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের। আজকের দিনে আর কেউ চরম আর্থিক সংকটে এ দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিবেন বলে আমার জানা নেই।
প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা কত বড় হৃদয়ের অধিকারী হলে বঙ্গবন্ধু করেতে পেরেছেন তা প্রাথমিক শিক্ষকদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। স্বাধীনতার পর শিক্ষার্থীরা পেয়েছে বিনামূল্যে খাতা, পেন্সিল, জামা-কাপড়, দুধ, ছাতু। বিদ্যালয় গৃহের নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়েছে টিন। তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি স্বল্পমূল্যে অলিম্পিয়া মিলের শার্টের কাপড়। শিক্ষার জন্য তাঁর স্বপ্ন ছিল বিশাল।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বরণের পর মানুষের শিক্ষা, অধিকার ও প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি মর্যাদার প্রতি বার বার আঘাত আসছে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের ভালবাসতেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিন্ন করতে প্রাথমিক শিক্ষাকে গ্রাম সরকার ও মিউনিসিপ্যালটির হাতে ন্যাস্তকরণে প্রাথমিক শিক্ষকদের তিন মাস ১০দিন ধর্মঘট করতে হয়েছিল।
২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সর্বপ্রথম ৫০৪ জন নেতৃবৃন্দ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি জিয়ারত করতে যাই। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশের ¯্রষ্টা, জাতির জনক, প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা প্রদানের কা-ারির মাজার জিয়ারত করার উপলব্ধিবোধ জাগ্রত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দেশ ও জাতির জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাথমিক শিক্ষা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর প্রাণ।
তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন শিক্ষা ছাড়া জাতির স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। সাধারণ মানুষের শিক্ষাকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালবাসার কথা, সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে জানাতে হবে। তার অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের শিক্ষকদের জানানোর দায়িত্ব আপনাদের। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে জাতির কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের নেতৃত্ব থেকে হারিয়ে যাবেন।
প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাত থেকে প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিক্ষকদের রক্ষা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করার অভিপ্রায়ে কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করছি।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে মূলমন্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সরকার। আজকের শিক্ষার্থীরা দেশের গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস, জাতীয় সংস্কৃতি জেনে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। অথচ জাতীয় ও বিশেষ দিবসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটির তালিকায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ দিয়ে শিক্ষকদের জাতীয় দিবস পালনের জন্য বলা হয়। এটা জাতির সাথে নিছক প্রতারণা। আমরা এ প্রতারণা বন্ধের জন্য আবেদন করে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অশুভ চক্রান্ত থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি।
স্কুল বন্ধ থাকলে ছুটি পাগল শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখা বা উপস্থিত করানো দুরূহ কাজ। নতুন প্রজন্মের শিক্ষক যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কর্মকা- দেখে আসছে বা বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষায় অবদান সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই, তাদেরও ছুটির দিনে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার মানসিকতা তেমন থাকে না। তাই ছুটি থাকায় দায়সারাভাবে জাতীয় দিবসসহ বিশেষ দিবসগুলো পালন করা হয়। গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু দুর্গম এলাকায় মোটেই পালিত হয় না। এর অবসানের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম কতিপয় সুপরিশমালা উপস্থাপন করে আসছে।
ক্স জাতীয় ও বিশেষ দিবস বিদ্যালয় কর্মদিন হিসেবে ঘোষণা করা। উক্ত দিনে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষক উপস্থিত হয়ে শ্রেণিওয়ারি দিবসের তাৎপর্য, গুরুত্ব, দেশের ইতিহাস,সংস্কৃতি জানানোর ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীদের যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারছে কি না, তা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
ক্স জাতীয় দিবস বা বিশেষ দিবসের ছুটিগুলো গ্রীষ্মের ছুটির সাথে যোগ করে শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, সরকারি কর্মচারীদের মত তিন বছর পর প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করা।
জাতীয় বা বিশেষ দিবসে বিদ্যালয় খোলা রেখে শিক্ষায় বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জন আগামী প্রজন্মকে জানানোর সুযোগ হবে।
এ সুপারিশমালা বাস্তবায়ন হলে আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধের ও দেশের গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি জেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষকরাও সঠিক ইতিহাস জানবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রাথমিক শিক্ষার সফলতা আসুক এ প্রত্যাশা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা