মো. সিদ্দিকুর রহমান
ত্রিশ লাখ শহিদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তখনকার বাংলাদেশ ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়েছিল। রাস্তাঘাট, পুল, রেলপথ,ও অনেক বাড়িঘর শুধু ছিলো ধ্বংস আর ধ্বংসস্তুপ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল শূন্য, চারদিকে অন্ন বস্ত্রের ও চিকিৎসার অভাব। বঙ্গবন্ধু বিদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, শিশুখাদ্য, অন্ন বস্ত্র এনে নায্যমূল্যের দোকান ও রেশন সপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়।
সে সময়ে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত গুড়া দুধ, ছাতু, খাতা, পেন্সিল, বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হত। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়গুলোতে টিন ও নগদ অর্থ দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। চারদিকে পরাজিত শক্তির দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থেকে পাটের গুদাম, মিল কারখানা ও বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করতেন।
বিভিন্ন খারাপ লোকদের হাতে অস্ত্র চলে যাওয়ায় চারদিকে ডাকাতি নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর আহবানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে দেশকে নৈরাজ্য মুক্ত করেন। দেশ স্বাধীন হলেও বিদেশি সাহায্য ছাড়া তখনকার সময়ে দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা গুলো পুরণ করা সম্ভব ছিল না।
দেশে শুধু অভাব, অনটন, নেই আর নেই। সে মুহুর্তে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ধ্বংসস্তুপ এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার কথা ভাবলেন। তিনি মনে প্রাণে উপলব্ধি করলেন শিক্ষা ছাড়া জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়।
তাই গর্বিত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তৃণমূল মানুষের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার কথা উপলব্ধি করলেন। কত বড় দূরদৃষ্টি সম্পূর্ণ বিশাল হৃদয়ের মহামানব ছাড়া অভাবের মাঝে এ উপলব্ধিবোধ কারো মাঝে জাগ্রত হতো কিনা জানি না? প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পেলেন।
বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জীবনে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরাবস্থার চিত্র সচক্ষে দেখেছেন। সামান্য কিছু টাকার জন্য হাটবারে প্রাথমিক শিক্ষকদের পোস্ট অফিসের পিওনের কাছে ধন্যা দেওয়ার করুণ দৃশ্য তার মনকে ব্যথিত করেছিল।
বিশেষ করে সকল পেশাজীবীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবহেলিত শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন না করে শিক্ষা বাস্তবায়নে শুধু স্বপ্ন থেকে যাবে। এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু জাতির জনক নয়, তিনি গরিব ও প্রাথমিক শিক্ষকদের অকৃত্রিম বন্ধু। আজকে প্রাথমিক শিক্ষকরা ভালোভালো ড্রেস, সুট, টাই পরিধান করে থাকে। সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা ,আর্থিক সুবিধা ও সেই দিন যদি বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ না করতেন আজও প্রাথমিক শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হত।
আজকের দিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এ দেশের তৃণমূল গরিব মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা যেন, অবহেলা না করি। আর শিক্ষকদের কাছে প্রত্যাশা আগে শিক্ষার্থীদের পাঠদান তাদের প্রধান কাজ। অফিসিয়াল বা অন্যান্য কাজ পাঠদানের পর করতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্যই তিনি শিক্ষক। কতিপয় শিক্ষক নেতা অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন শিক্ষা অফিসে পাঠদান না করে সার্বক্ষণিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকে।
তাদের সম্পর্কে বলতে হয়, ‘শিক্ষার্থী চেনে না শিক্ষক তিনি আবার কেমন শিক্ষক নেতা’। প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের ওপর বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিদানে ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের শিক্ষকতার পেশা থেকে বাইরে রাখতে হবে।
শিক্ষা সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। এ উপলিদ্ধিবোধ গরিব অশিক্ষিত জনগণের মাঝেও ব্যাপকভাবে জাগ্রত হয়েছে। বর্তমানে হতদরিদ্ররাও শত অভাবের মাঝে সন্তানদের শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠবোধ করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ সহ অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষা যে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ এ বোধটুকু সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে দৃশ্যমান নয়। বর্তমানে আমরা দেখেছি শিক্ষক নেতৃদৃন্দ কর্মকর্তা ,মন্ত্রীসহ সকলকে তোষামোদী বা গুণগান দিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার কাজে রত থাকতে।
বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিক্ষকদের সমস্যা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে পেরেছেন কিনা বিষয়টি সকলকে ভাবিয়ে তুলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিনামূল্যে বই বিতরণের বিশাল কর্মযোগ্য ম্লান করে দিয়েছে নোট গাইড। শিক্ষক সংকট দুর করার আশু ব্যাবস্থা নিয়ে কোন উদ্যোগ নেননি। শ্রান্তি বিনোদনের ভাতা বিলম্বে প্রদানে শিক্ষকদের আর্থিক ক্ষতি করে সরকারি কর্মচারী অধিকারহরণ করা হচ্ছে। সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যসহ অসংখ্য সমস্যা বিদ্যামান। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব হলেও শিক্ষকদের সাথে সরকারের দুরত্ব সৃষ্টি করেছে প্রশাসন। এছাড়াও বেতন বৈষম্য দুর না করে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছে তারা। সংশ্লিষ্টদের কাজ যেন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জিইয়ে রাখা বা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা। সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করতে হবে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণ করার পর শিক্ষকদের ওপর নেমে আসে মহাদুর্যোগ। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা পৌরসভা ও গ্রাম সরকার সরকারের অধীনে ন্যাস্ত করা হয় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম পেশাজীবীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকেরা দুই লাখ লোক নিয়ে ঢাকা শহর অবরোধ করে অচল করে দেন।
অবশেষে তিন মাস দশদিন ধর্মঘট করে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের অধ্যাদেশ বহাল রাখে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। এ ঋণ লাঘবের জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্তরিকতার সাথে কাজ করার প্রয়োজন । প্রাথমিক শিক্ষার সকল চ্যালেঞ্জ দূর হোক। বাস্তবায়ন হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ।
লেখক: আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা