অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন
একুশে ফেব্রুয়ারি একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে আন্দোলনরত শহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর একুশ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ দিনটি শহিদ দিবস এবং জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও স্বীকৃত।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয়। পাকিস্তানে চার কোটি ৪০ লাখ বাঙালি (বাংলাভাষী) পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ববাংলা) অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়, মুদ্রা ও ডাকটিকিট থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি গণপরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবি জানিয়ে একটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণপরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, বর্ধমান হাউস, হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে সবাইকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখিন হতে হয়। কয়েকজন গ্রেফতারও হন। গ্রেফতারদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। এরপর ১২ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চেই বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ ভাষা আন্দোলনকে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ষোষণা দেন। তিনি ২৪ মার্চ কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনঃব্যক্ত করেন। ছাত্ররা এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনের এক জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এদিকে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচার ও প্রচলন করার জন্য সারা দেশে সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত এক সভার মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সময় সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করে। এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি এক মাসের জন্য সকল সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ওইদিন রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়ে ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে এবং তারা রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এসময় কিছু ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয় । কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেন। এই ঘটনায় পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন ছাত্র শহিদ হন। তাদের প্রাণদান ছিল মাতৃভাষায় কথা বলাসহ অধিকার আদায়, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। ঐ ঘটনায় সরকারি হিসেবে চারজন শহিদ হন। জনশ্রুতি আছে, পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহিদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে এবং ২৪ তারিখ ভোরে শেষ করে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবলই উর্দু’ ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করলে ৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ৭ মে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে গণপরিষদে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায়। ৬ জানুয়ারি ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক সরকার একটি সরকারি বিবৃতি জারি করে এবং ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানের নীতি ‘দুই রাষ্ট্র ভাষা’ সমর্থন করে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বহাল করে।
দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হলো, পাকিস্তান থেকে ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং স্বাধীনতা অর্জন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কানাডায় বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে । ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বিশ্বের ১৯৩ দেশ গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করে। এ দেশে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের আজকের বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে রেসকোর্স ময়দানে তিনি উচ্চারণ করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উচ্চারণ-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এই ঘোষণার পর পরই বাঙালিদের মধ্যে নেমে আসে স্বৈরশাসকের দমন-পীড়নের পরাকাষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বন্দী করে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। বাংলাদেশে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। মেহেরপুরের মুজিবনগরে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপিল গঠিত প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ ৯ মাস স্থায়ী হয়। ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদূর প্রসারী ফলশ্রুতি।’ আজন্ম মাতৃভাষা প্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব, পরবর্তী সময় আইন সভার সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। আজন্ম তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে জন্য কাজ করে গেছেন। বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের দাবির কথা বলে গেছেন। এই ভাষার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখা সকল বাংলাদেশি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। এই ভাষার আধুনিকায়ন এবং সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করাই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।