বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন-অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মহানায়ক। কথাটি কেবল বাঙ্গালি নয় সমগ্র দুনিয়ার মানুষ জানে। কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আমাদের দেশেও অনেকের অজানা। সে কথাটি সবাইকে জানাতে হবে।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক অবিস্মরণীয় নাম। তার জন্ম না হলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। ঠিক তেমনি ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবকে পৃথক করে দেখার কোনো অবকাশ  নেই। শুধু কি তাই? বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির সংগ্রামেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক জুড়ে বাঙ্গালির দুই অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের হাত ধরে রাজনীতিতে তার অবাধ বিচরণ। তিনি রাজনীতির এ দুই দিকপালের একান্ত স্নেহভাজন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নের সময় শেখ মুজিব বার বার এ দুই মহান নেতার সান্নিধ্য পেয়েছেন। সময়টি উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী  আন্দোলনের সময়। সুযোগটি হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার একান্ত সময়। দুই গুরুর সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে তিলে তিলে বাঙ্গালির মহান নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার অবারিত সুযোগ লাভ করেন। আস্তে আস্তে তিনি হয়ে ওঠেন মহানায়ক। হয়ে ওঠেন বাঙ্গালির অসাধারণ এক ত্রাণকর্তা। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন-'আজও আশা করে আছি পরিত্রাণ কর্তা আসবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে, চরম আশ্বাসের কথা শুনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকেই।' রবীন্দ্রনাথের সে আকাঙ্খাটি পূরণ করতে বাঙ্গালির মুক্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভুত হন শেখ মুজিব।             

বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রেম ও আনুগত্য ছিলো অসাধারণ। শেখ মুজিব তখনি শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হয়ে ওঠেন যখন তার মুখে শুনতে পাই- 'ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার আগে আমি বলব, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। আমি বাঙ্গালি। জয় বাংলা।' ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা সংগ্রামের সূচনা পর্ব থেকে শুরু করে ’৫২-র চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত তার সগর্ব অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি রাজপথে সংগ্রাম করেছেন। ভাষার জন্য কারাবরণ করেছেন। আইনসভার সদস্য হিসেবে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় একটি সম্মেলনে গঠন করা হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এ সম্মেলনে ভাষা বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক গাজিউল হক তার 'ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা' গ্রন্থে বলেন-'সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সে সময়ের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো এরকম ছিলো-‘১. বাংলা ভাষাকে পুর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক ২. সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হউক ৩. জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল' নামে যে পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় সেটি প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান রাখেন। তাতে ১৪ জন স্বাক্ষরদাতার মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিলো- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

       
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হরতাল পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনে এটি ছিল প্রথম হরতাল। এ হরতালে নেতৃত্ব দেবার কারণে বঙ্গবন্ধু পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদ 'জাতীয় রাজনীতি-১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ ' গ্রন্থে লিখেন  'আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গেপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরের দিন হরতাল কর্মসূচীতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত

করে।' বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি' গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে কারাবরণ সম্পর্কে বলা হয়- 'স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটি তার প্রথম গ্রেফতার।' এক পর্যায়ে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে মুখ্যমন্ত্রি খাজা নাজিম উদ্দিন আন্দোলনকারীদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে আপস রফার উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরের আগে সেটি ভাষা আন্দোলনের কারাবন্দীদের দেখিয়ে তাদের অনুমোদন নেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে সে চুক্তিপত্রটি দেখে অনুমোদন দেন। এ চুক্তির কারণে বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং বঙ্গবন্ধুসহ কারা বরণকারী ভাষা সৈনিকরা মুক্তি পান।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় যে সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন। এক কথায় শেখ মুজিব, তাজ উদ্দিন আহমদ, আব্দুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ নেতার আপ্রাণ চেষ্টায় ভাষা আন্দোলন সারা দেশে গণ-আন্দোলনে পরিণত হতে পেরেছিল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের নানা কর্মসূচি থেকে বঙ্গবন্ধু আরো দু'বার কারা বরণ করেছিলেন।

'৫২-র ভাষা আন্দোলনের চরম পর্বে মুজিব ছিলেন কারাগারে । দৈহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তখন অনুপস্থিত থাকলেও আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দের সাথে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামারুজ্জামান প্রমুখের কাছ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে চিরকুটের মাধ্যমে তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ পাঠাতেন। 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি'-এ অমর গানের রচয়িতা আব্দুল

গাফফার চৌধুরি  'একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন 'শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।' ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার বিপক্ষে অবস্থান নিলে শেখ মুজিব তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার মত পরিবর্তন করাতে সক্ষম হন। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেটি সম্ভব হয়েছিল। শেখ মুজিবের পীড়াপীড়িতে জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হন।

সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি প্রকাশের পর মাওলানা ভাসানী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় এরকম একটি বিবৃতি দেন-'বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে শেখ মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।'                                              

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলন সমাপ্ত হলেও বাংলা ভাষাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ মুজিবের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে বঙ্গবন্ধু অসামান্য ভুমিকা পালন করেন। একুশের প্রথম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ঘোষণা এবং বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা করার আহ্বান জানান। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে তিনি আইন

পরিষদের প্রতিদিনের কর্মসূচি বাংলা ভাষায় ছাপানোর দাবি জানান এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জোরালো আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দেশের প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পরিচিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। বাঙ্গালি এক গর্বিত জাতি। এ গৌরব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি শেখ মুজিবের।

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

SUMMARY

2093-1.gif