কারাগারের রোজনামচা: ইতিাহসের অশ্রুগাথা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথেই আমাদের চোখের সামনে তাঁর যে ছবিটি ভেসে উঠে সেটি ৭-ই মার্চের। অবলীলায় তখন শুনতে পাওয়া যায় তাঁর বজ্রকন্ঠের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণার এই পঙক্তিকে আমি শুধু ঘোষণা বলতে নারাজ, এই চয়নগুলোকে আমি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই! কারণ এ কবিতাই সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে এনে দিয়েছিল একটি মানচিত্র, একটি পতাকা। এই কাব্যমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ঝাপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপন লড়াই চালিয়ে পাওয়া স্বাধীনতায় মূল শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর অমরত্বের তিলকপড়া এই লাইনগুলো।
একটি কথা হলফ করে বলতে পারি, বাঙালিমাত্রেই এই লাইনগুলো ঠিক যতবার শুনেছে আর কোনও পংক্তি এতবার শুনেনি। তাই কালজয়ী এ লাইনগুলোকে আমি বঙ্গবন্ধু রচিত শ্রেষ্ঠ কবিতাই বলবো। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন।
একদিনের প্রচেষ্ঠায় কি বঙ্গবন্ধু এই অসাধারণ ‘কবিতা’টি রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন, নিশ্চই না। একদিনে যেমন কবি হওয়া যায়না তেমনি লেখকও হওয়া যায়না একদিনে। লেখক হতে গেলে থাকা চাই নিবির অধ্যবসায়। যা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল তীব্রভাবে। সাংবাদিকতা করে শব্দের সাথে যে সখ্যতা তিনি গড়ে তুলেছিলেন জীবনের প্রথমভাগে সেটিই কাজে লাগিয়েছেন কারা অভ্যন্তরে কাটানো দিনগুলোতে। যার ফলে তাঁর কাছ থেকে আমরা যেমন পেয়েছি ‘মুক্তির কবিতা’ তেমনি পেয়েছি সেই কবিতা রচনার ইতিহাস, পটভূমি। যা একাধিক গ্রন্থাকাকারে প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যে। ‘অসমাপ্ত অত্মজীবনী’র পর ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হওয়ায় ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় খোলাসা হয়েছে জাতীর সামনে।
‘কারাগারের রোজনামচা’-এমন এক গ্রন্থ যেখানে উঠে এসেছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বের অজানা অনেক কথা। ৬ দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালির শোষণমুক্তির যে রূপরেখা দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নে কি বিভীষিকাময় সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে তাঁকে তা তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছেন তিনি রোজনামচায়। কিন্তু এর কতটুকুইবা ভাষায় প্রকাশ করা যায়। অত্যাচার নির্যাতনের কথা যতটুকুনা বলে বোঝানো যায় তার চেয়ে বেশি অনুধাবন করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ত্যাগের, সহ্যের, দৃঢ়তার, মানুষের প্রতি ভালোবাসার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তার দলিল বলা চলে এই গ্রন্থটিকে।
রোজনামচা অর্থাৎ দিনলিপি, তাও কারাভ্যন্তরের। স্বভাবতই প্রশ্নজাগে কারা অভ্যন্তরে কেমন ছিলেন বাঙালীর মহানায়ক, তার দিন কেটেছে কিভাবে, কারা সংশ্লিষ্টরাই বা কেমন আচরণ করেছে তাঁর সাথে? আগ্রহ নিয়ে যখন কারাগারের রোজনামা পড়তে শুরু করি তখন এই ভাবনাটিও মনে এলো, কারাগারের প্রাত্যহিকতা পড়তে কি ভালো লাগবে? একঘেয়ে যদি হয়? এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই পড়তে শুরু করলাম। আগেই জানিয়ে রাখি পড়তে গিয়ে একটিবারের জন্যও ক্লান্তি আসেনি। কিন্তু পড়তে পড়তে অনেক সময় থমকে যেতে হয়েছে চোখ ভিজে যাওয়ায়। নিস্তব্ধ থাকতে হয়েছে কিছু কিছু ঘটনার বিবরণে। মনোভূতিতে তখন তোলপাড় হয়েছে। নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করেছি, একটি মানুষ কী করে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন এমনভাবে? পরিবার পরিজন রেখে এক অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে পারেন মানুষের কল্যানে? করুণ পরিস্থিতির মাঝেও অবিচল থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন জাতীকে? বঙ্গবন্ধু বলেই বোধহয় সম্ভব হয়েছিল সেটা।
আজ মুক্তিযুদ্ধের পয়তাল্লিশ বছর পর স্বাধীনতার ইতিহাসকে যখন বিকৃত করার অপচেষ্টা চালানো হয় তখন সত্যিই হতবাক হতে হয়Ñ একথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যারা এমনটি করেন তারা যদি একবার ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়েন তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীনতাকে নিয়ে আর কোনও কথা বলবেন না কখনো সজ্ঞানে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের রূপরেখা যে ৬ দফার মধ্যেই নিহিত ছিল রোজনামচা তার অনন্য দলিল। কারণ ছয় দফার কারণেই ঐ সময় গ্রেফতার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। শুধু তাই নয়, প্রহসনের বিচারে একাধিক মামলায় দেওয়া হয়েছিল শাস্তি তাঁকে, উচ্চ আদালতে সেগুলো খারিজ হয়ে গেলে বিনা বিচারে রাখা হয়েছে আটক, এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু মানুষের ভালোবাসার কাছে সেদিন পরাজিত হতে হয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রকে।
এ কথা অকপটেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি না করে যদি শুধুমাত্র লেখালেখি করতেন তাহলেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেতেন। কিন্তু তাতে কি? এ পর্যন্ত তাঁর লেখা যে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস সৃষ্টি করে আসীন হয়েছে অনন্য উচ্চতায়। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এ পর্যন্ত যত বই প্রকাশ হয়েছে তারমধ্যে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বই দু’টি। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় বঙ্গবন্ধু আজও আমাদের কাছে কতোটা প্রাসঙ্গিক, কতোটা জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, প্রকৃত ইতিহাস জানার অমোঘ আকর্ষণ থেকেও অগনিত পাঠক বই দুটি ক্রয় করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির বিশ্বাসের ভিত কতোটা মজবুত তারও প্রমাণ পাওয়া যায় এ থেকে।
‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে আমার একটি ভিন্নতর উপলব্ধি হয়েছে। যখন পড়েছি একটি বারের জন্যও মনে হয়নি এটি শুধু রোজনামচা। বিবরণ এতই সাবলীল যে মনে হয়েছে জীবনাখ্যান বিবৃত করেছেন বঙ্গবন্ধু। কখনো কখনো মনে হয়েছে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ছি। যে উপন্যাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু নিজে। বইয়ের সবচেয়ে অতূলনীয় দিকটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বিনয়। ৩৩২ পৃষ্ঠার কোথাও কোনও অতিকথন নেই। নিজেকে জাহির করারও কোনও প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি কোথাও। এমনকি আওয়ামীলীগের সভাপতি হওয়া সত্বেও কোথাও একটিবারের জন্যও তিনি তা উল্লেখ করেন নি।
একেবারে সাধারণভাবে, সাদামাটাভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরন তিনি দিয়েছেন। কখনো কখনো নিজের অভিমত তিনি তুলে ধরেছেন। ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তাও তিনি কল্পনা করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাবনার সাথে বাস্তবতা মিলে গেছে হুবহু। ভাবতে অবাক লাগে, বিস্ময়ও জাগে একজন মানুষ এতটা দূরদর্শী হতে পারেন কি করে? একদিকে রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটকে রাখা- এই পরিস্থিতিতে ৬ দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্ভার থাকা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে। এখানেই ফুটে উঠে তাঁর চরিত্রের অতিমানবিতা। তখন মহাকাব্যের মহানায়কের কথাই মনে পড়ে। অথচ সেই মহানায়ককে সত্যি সত্যিই একদিন কাছে পেয়েছিল বাঙালি।
আমাকে যদি রোজনামচা নিয়ে মোটা দাগে কিছু বলতে বলা হয়, আমি বঙ্গবন্ধুকে একজন দক্ষ লেখক হিসেবেই আখ্যায়িত করবো। কারণ পুরো রোজনামচা পড়তে গিয়ে একটিবারের জন্যও থমকে যেতে হয়নি কোথাও। মনে হয়েছে এটি প্রফেশনাল লেখকের লেখা। তবে এই দক্ষতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর নিজের যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি ছিল প্রচুর পড়াশোনার অভ্যাস। সেইসাথে ছিল বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের তাগিদ। রোজনামচা রচনায় সহধর্মিনী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, পারিবারিক, মানসিক এবং রাজনৈতিক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। তা না হলে হয়তো আজ আমরা ইতিহাসের এই অনন্য দলিল পড়ার সুযোগ পেতাম না। যে খাতাগুলোর বদৌলতে কারাগারের রোজনামচা সেগুলোকে একাত্তরে রক্ষা করা, পরর্বীতে লুকিয়ে রাখা এবং হারিয়ে যাওয়া, পুনরায় ফিরে পাওয়া-এ সবই যেনো সেই অমোঘ সত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কখনো তামাদি হয়না। আর এক্ষেত্রে ফজিলাতুননেছা মুজিব এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের বুদ্ধিমত্তার ফসল আজকের কারাগারের রোজনামচা।
সে কথা ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা -‘ আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌছে দিতেন, আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযতেœ রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কারাভ্যন্তরে বসে লেখা খুবই কঠিন কাজ। কারণ এতে আবেগতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। নিজ বেদনাগাথাকে তুলে ধরা বা চিত্রিত করা যে কতটা কঠিন তা যারা এই পরিস্থিতিতে পড়েছেন কেমলমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর অধিকাংশ সময়ই তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। সিলেটসহ দেশের একাধিক কারাগারে স্থানান্তর করা হলেও ফের তাকে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়। সে সময় তিনি ঘটনাপ্রবাহকে লিখে রাখেন খাতার পাতায়।
রোজনামচা পাঠে আমরা জানতে পারি, কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে একাকি রাখা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা ছিল তাঁর সাথে অন্যান্য কয়েদিদের কথা বলার ক্ষেত্রেও। যদিও এটি ছিল সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। ধারণা করুন একেতো কারাগারে তার উপর কথা বলায় বিধিনিষেধ। কি করে কাটবে একটি মানুষের দিন। মানুষই যার ধ্যান, জ্ঞান তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখা কতো বড় শাস্তি তা বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই।
বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘শুধু দুঃখ হয় এদের অত্যাচারের ধরনটা দেখে। আমার উপর এতো অত্যাচার না করে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেললে সব ল্যাঠা মিটে যেত।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার নাম, কারাপ্রাচীরের অভ্যন্তরে রেখে কি তাঁকে আটকানো যায়। নিশ্চই না। তিনি নিত্যসঙ্গী করে নিলেন বই-কে। সেইসাথে খবরের কাগজ পড়া, সময় কাটানোর জন্য কখনও কখনও নিজেই করেছেন নিজের রান্না, কখনওবা করেছেন বাগান পরিচর্যা। সুন্দরের পূজারি বঙ্গবন্ধুতো ফুলই ফুটাবেন। কারাগারের বাগানেও ফুটালেন ভালোবাসার ফুল। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য থেকে উদ্ধৃত করছি-
‘একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালো বাসতে আরম্ভ করেছি। যাদের যাদের ভালোবাসি ও স্নেহ করি তারাতো কাছে থেকেও অনেক দূরে। ইচ্ছে করলে তো দেখাও পাওয়া যায় না। তাই তাদের কথা বার বার মনে পড়লেও মনেই রাখতে হয়। স্ত্রী ছেলে মেয়েদের সাথে তো দেখা করারও উপায় নাই। শুধু মনে মনে তাদের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া উপায় কি! (পৃষ্ঠা ১২৩)
স্বজনের ব্যাথায় কাতর বঙ্গবন্ধু বার বার উল্লেখ করেছেন মা বাবার কথা, স্ত্রী সন্তানদের কথা। আপনজন থেকে দূরে থাকায় বিক্ষত হয়েছে তাঁর হৃদয়, ক্ষরণ হয়েছে কিন্তু তা কখনও বুঝতে দেননি স্ত্রী সন্তানদের। অসুস্থ মা বাবাকে দেখতে ছটফট করেছেন তিনি। শুনতে চেয়েছেন তাদের মুখ থেকে ‘খোকা’ ডাক। রোজনামচার নিবিড় পাঠেÑ তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না এতটুকু।
শেখ রাসেলের কথা বার বার তিনি তুলে ধরেছেন, যখনই কারাগারে সাক্ষাৎ করতে সন্তানদের সাথে নিয়ে এসেছেন ফজিলাতুননেছা। প্রায় প্রতিবারই সঙ্গে এনেছেন রাসেলকে। বঙ্গবন্ধু না পৌছা পর্যন্ত সে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতো। পরিবারের ছোট সন্তান বলেই হয়তো তাঁর প্রতি বাড়তি মায়া ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাই বিশেষভাবে তিনি রাসেলের সাথে কাটানো মুহূর্তের কথা উল্লেখ করেছেন রোজনামচায়। যখনই রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু তখন তার নিষ্পাপ মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছে চোখের সামনে? পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট নির্মমভাবে চালানো হত্যাকাণ্ডে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল? কি দোষ করেছিল সে? ওতো রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। একবারও কি খুনিদের হাত কেঁপে উঠেনি সে সময়। এতোটা পাষান কি মানুষ হতে পারে, তারা কি মানুষ? নিশ্চই না, তারা মানুষ হতে পারেনা। খুনিরা মানুষ নয়, অমানুষ।
বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন বহিঃশত্র“র চেয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্র“রাই বেশি ক্ষতিকর। যুগে যুগে কালে কালে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই বারংবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলা, বাঙালিরা। স্বার্থের জন্য আমরা নিজেরাইযে নিজেদের বারোটা বাজানোর জন্য সিদ্ধহস্ত তারও প্রমান দিয়েছেন তিনি।
অনেকক্ষণ ভাবলাম, এইতো দুনিয়া! জনাব সোহরাওয়ার্দীকে ‘চোর’ বলেছে, হক সাহেবকে ‘চোর’ বলেছে, নেতাজি সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা ‘চোর’ বলেছে, দুঃখ করার কি আছে! (পৃষ্ঠা ১৮৯)
নীচতাই আমাদের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ বঙ্গবন্ধু তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আক্ষেপ করে বলেছেন- কাকেরাও ঐক্যবদ্ধ হয়, অথচ আমরা বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনা!
আগেই উল্লেখ করেছি গ্রন্থটিকে স্রেফ দিনলিপি বলতে অনাগ্রহী আমি। কারণ ঐতিহাসিক এই দিনলিপির মধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধের অমোঘ মন্ত্র। যে মন্ত্র রাজনীতির পাঠশালার প্রত্যেক ছাত্রের পড়া উচিৎ। ত্যাগের, সহ্যের ক্ষমার যে বিরল উদাহরণ তৈরি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু তা এক কথায় অতুলনীয়।
আজ সমাজের নানা স্তরে আইন অমান্য করার যে মানসিকতা লক্ষ্য করা যায় সেখানেও বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ইচ্ছে করলেই তিনি আইন অমান্য করে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু সে পথে অগ্রসর হননি; মানুষের কথা চিন্তা করে দিয়েছেন কর্মসূচি, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস সেই বিশ্বাস ছিল তাঁর মর্মমূলে।
ছয় দফাকে যখন পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলা হলো- তিনি বললেন এটা যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে এর ‘পরিণতি হবে ভয়াবহ’- সেটা শুধু অনুমানই করেননি বার বার বলেছেন, লিখেছেন রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধু যা ভেবেছিলেন তাই হলো। একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হলো তাঁকে। সকল ষড়যন্ত্র ভেদ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হলো বাংলার আকাশে।
রোজনামচার উপস্থাপন শৈলী এককথায় অনবদ্য। সহজ-সরল প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যবহার ইতিহাসের এই উপাদানকে করেছে সহজপাঠ্য। বঙ্গবন্ধুর বর্ননা এতটাই নিখুতযে পাঠকালে মনে হয়েছে ঘটনাগুলো ঘটছে আমাদের চোখের সামনে। এখানেই লেখক হিসেবে তাঁর স্বার্থকতা। বঙ্গবন্ধু যেভাবে বক্তৃতা দিতেন- ঠিক সেভাবে সেই ভাষা ব্যবহার করে লিখেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। যা রাজনীতিবিদদের অবশ্যপাঠ্য বলে মনি করি। সহজপাঠ্য এ রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু সাহিত্যের নানা উপমা ব্যবহার করেছেন। এ থেকে তাঁর সাহিত্যপ্রেমের যেমন পরিচয় পাওয়া যায় তেমনই গভীর পাঠাভ্যাসও উপলব্ধি করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তাঁর চেতনবিশ্ব জুড়ে ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় রোজনামচায়।
জেলের ঘানি টানতে টানতে যখন তাঁর নাভিশ্বাস উঠার অবস্থা তখন শক্তি সঞ্চয়ে উচ্চারন করেছেন- ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ একবার নয়, একাধিকবার রবী ঠাকুরের এই পঙক্তিগুলো লিপিবদ্ধ আছে রোজনামচায়। শুধু রবী ঠাকুরই নন, শরৎচন্দ্রও বিরাজমান ছিলেন তাঁর ভাবনার জগতে। অনেকটা আবশ্যিকভাবে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,
ভাবি রাজনীতি মানুষকে কত নিষ্ঠুর করে! কয়েদিদেরও মায়া আছে, প্রাণ আছে, কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের নাই। ভাবলাম রাতটা কাটাতেই কষ্ট হবে। কিন্তু কেটে গেল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’, দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই। আর তাঁর মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই। (পৃষ্ঠা ৮০)
সাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধ থাকার কারনেই করুণদিনেও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রের দারস্থ হয়েছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন তাদের সাহিত্যের সদর-অন্দর। আর তার প্রভাবে ঋদ্ধ হয়েছে রোজনামচা।
একাকীত্বের বেদনাকে তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাকে একবাক্যে অনন্য বলা যায়। সংবেদশীলভাবে সে বেদনাগাথা উপস্থাপন করে প্রমান করেছেন মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। আমরা যদি বঙ্গবন্ধু আর তাঁর লেখক সত্ত্বাকে পৃথক করি তাহলে প্রত্যক্ষ করবো অসাধারণ এক ভিন্নতা। কারন এই রোজনামচায় শুধু কারা অভ্যন্তকরের দিনগুলোর কথাই তুলে ধরেন নি, তৎকালীন সরকার ব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থাও তিনি তুলে ধরেছেন নিখুতভাবে। শুধু দেশই নয় বিশ্বরাজনীতি নিয়েও তাঁর চিন্তা ভাবনা উঠে এসেছে রোজনামচার পাতায়। হলুদ পাখি, সবুজ ঘাসের বর্ননা, পাগলদের উৎপাতে ঘুম না হলেও তাদের জন্য মায়া, কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভালো ব্যবহার সবই তিনি তুলে ধরছেন সুনিপুনভাবে। আবার ফিরে এসেছেন বদ্ধ কুঠিরে। বলেছেন,
সূর্য অস্ত গেল, আমরাও খাঁচায় ঢুকলাম। ‘বাড়িওয়ালা’ বাইরে থেকে খাঁচার মুখটা বন্ধ করে দিল। বোধহয় মনে মনে বললাম, আরামে থাক, চোর ডাকাতের ভয় নাই, পাহাড়া রাখলাম।... ‘লোহার শিকগুলি ও দেওয়ালগুলি বাধা দেয় সন্ধ্যার পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ দেখতে। বাইরে যখন ছিলাম খোলা আকাশ দেখার সময় আমার ছিলনা। ইচ্ছাও বেশি হয় নাই। (পৃষ্ঠা ১৬৮)
যখন যা মনে এসেছে কোন রাখঢাক না করে তা-ই লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। মনোভাব প্রকাশ করেছেন নির্দিধায়। এখানে একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করা যেতে পারে। জেল জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত বিষয় হচ্ছে, স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তৎকালীন সময়ে রাজবন্দিদের পনেরো দিনে একবার ঘনিষ্টদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হতো। তাও মাত্র বিশমিনিটের জন্য। স্বল্প সময়ের এই সাক্ষাৎ উল্টো ব্যথাতুর করে তুলতো বঙ্গবন্ধুকে। তাইতো তাঁর কাছ থেকে আমরা অভিমান ভরা কন্ঠে শুনতে পাই, ‘আরম্ব করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝেনা যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছে হয়, কিন্তু উপায় কি? আমরাতো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষনীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে। কিন্তু বলার উপায় নাই। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যেনো না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম ঢাকায় আসতে, কারন ও তখন দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাড়ি থাকত।’
নেতা হিসেবে সহকর্মীদের জন্য ব্যাকুলতা, কয়েদিদের জন্য সমমবেদনা, দেশের মানুষের জন্য দুশ্চিন্তা অন্যদিকে পরিবার পরিজনের জন্য ভাবনা সবকিছুই তিনি চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন রোজনামচায়। যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ৮ দফা দিয়ে ৬ দফা দাবিকে ভন্ডুল করার চক্রান্ত, ছয় দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা, আওয়ামীলীগের প্রায় সকল নেতাকে গ্রেফতার করে কারান্তরীন করা, কোথাও কোনও সুখবরের আশা না থাকলেও বাংলার জনগনের প্রতি ঠিকই অগাধ বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি জানতেন, বাঙালিরা জেগে উঠবেই। আর জেগে উঠলে রক্ষে থাকবেনা হায়নাদের। বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ্বাসের কারন মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সে কারনেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা রেখেছিল বাংলার মানুষ। আর সেখানেই ভয় ছিল পাকিদের। এমনকি প্রহসনের বিচার কার্যক্রম কোর্টে পরিচালনার সাহস পায়নি সরকার। জেলগেটে কোর্ট বসিয়ে বিচার করেছে। রায় দিয়েছে। তাদের ধারণা ছিলো আদালতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলে নিয়ন্ত্রন করা যাবে না জনস্রোত।
কারা অভ্যন্তরে কাটানো দিনগুলোর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত ১২টার পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু জেলগেট থেকে তাঁকে পুণরায় গ্রেফতার করে ক্যান্টনম্যান্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। প্রায় পাচমাস তাঁকে একা থাকতে হয়। পরিবার, পরিজন কারো সাথেই তখন সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে সেখানে রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। প্রথমত তাঁর সাথে কারো কথা বলায় নিষেধ ছিল, দ্বিতীয়ত ক্যান্টনমেন্টে তখন বাংলাভাষী কেউ ছিলনা। দিনের আলো দেখার সৌভাগ্য হয়নি এই পাচমাসে। ঐ সময়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। নিজ বুদ্ধিমত্তায় সেযাত্রা রক্ষা পান তিনি। এমন পরিস্থিতিতে যে পড়তে পারেন তা আগেই উপলব্দি করেছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন তাই লিখেছিলেন-
আমার যেমন নিঃস্বার্থ বন্ধু আছে, আমার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে, তেমনই আমার শত্র“ আছে, যারা হাসতে হাসতে জীবনটা নিয়ে নিতে পারে। আমাকে যারা দেখতে পারেন না, তারা ঈর্ষার জন্যই দেখতে পারে না। জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেজন্যই নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি। (পৃষ্ঠা ১৭২)
শিহরন জাগানিয়া এমন অনেক আখ্যান রয়েছে কারাগারের রোজনামচায়। আর সেটি যথাযথভাবে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে পিতার যোগ্য উত্তরসূরির ভূমিকাই পালন করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেই লিখেছেন বইটির ভূমিকা। তাতে তিনি যে খাতাগুলোর বদৌলতে তৈরি হয়েছে এই রোজনামচা সেগুলো আগলে রাখা উদ্ধার করা এবং বই আকারে প্রকাশে নূন্যতম ভূমিকাও যাদের রয়েছে তাদের কথা স্বীকার করেছেন অকপটে। ভূমিকাতে পুরো বইয়ের রূপরেখা তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সংশ্লি¬ষ্টদের ঋন স্বীকার করে বঙ্গবন্ধু কন্যা রক্ষা করেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। বইটির নামকরন করেছেন বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা। নামকরনের স্বার্থকতা বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, তার স্বার্থক রূপায়ন বলা চলে কারাগারের রোজনামচাকে। দিন, তারিখ, মাস এবং সাল ব্যবহার করার কারনে ঐতিহাসিকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে ইতোমধ্যেই বিবেচিত হয়েছে বইটি। বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, টীকা, আলোকচিত্র, ৬ দফা, নির্ঘন্ট সংযোজন, শুরুতে কারাগারের দফা সম্পর্কে ধারণা রোজনামচাকে দিয়েছে পরিপূর্ণতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকাংশের কিছু কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছেন ‘ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলি যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগুতে হয়েছে তার কিছুটা এই কারাগারের রোজনামচা বই থেকে পাওয়া যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদা বাঙালি পেয়েছে যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেই সংগ্রামে অনেক ব্যথা বেদনা, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস রয়েছে। মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহৎ অর্জন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ডায়েরি পড়ার সময় চোখের পানি বাধ মানে না। রেহানা, বেবী ও আমি চোখের পানিতে ভেসে কাজ করেছি।’ সত্যিই তাই বিবেক সম্পন্ন কোনও মানুষের পক্ষেই কারাগারের রোজনামচা পড়ে চোখের জল ধরে রাখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে রাসেল প্রসঙ্গে যখনই কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু তখনই বিক্ষত হয়েছে হৃদয়। রাসেল প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন,
‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘‘আব্বা বালি চলো’’। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘‘ তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ (পৃষ্ঠা ২৪৯)
রাসেলের আবদার রক্ষা করতে না পারায় বঙ্গবন্ধুযে মনোকষ্ট পেয়েছেন তা এই লাইনগুলো পাঠে অনুমান করা যায় সহজেই। তারপরও অগনিত সন্তানের কথা চিন্তা করে নির্বিকার থাকতে হয়েছে তাঁকে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, যে কোনও সময় চরম পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতে পারে তাঁকে। এ কারনে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতেন সবসময়। এ কারনেই বলেছিলেন, ‘আজকের এই ত্যাগ এমনকি আমার মৃত্যুও যদি হয় এই আন্দোলনের ফল একদিন না একদিন ভোগ করবে বাঙালি।’ সত্যি সত্যিই তাই তাঁর আন্দোলনের ফল আজ ভোগ করছে বাঙালি।
শুরু করেছিলাম যে কবিতার লাইন দিয়ে, সে কবিতার আরেকটি অংশ বলে শেষ করতে চাই আলোচনা। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কন্ঠে সেই কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, তবুও এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো।’ দেশকে মুক্ত করেছেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, মুক্ত স্বদেশেই সপরিবারে আত্মোৎসর্গ করতে হয়েছে তাঁকে। সেইযে বলেছিলেন, এমন অনেক শত্র“ আছে যারা হাসতে হাসতে তাঁর জীবন নিতে পারে! বঙ্গবন্ধুকে ওরা বাঁচতে দিলনা। কিন্তু ওরা বোধহয় জানতো না ইতিহাসের মহানায়কেরা মরেনা-তারা অমর, তাদের মৃত্যু নেই। তারা সাথে করে নিয়ে আসেন মৃত্যুহীন প্রাণ। চেতনার মধ্যে, আদর্শের মধ্যেই বেঁচে থাকেন তারা চিরকাল।