৭মার্চেই ঘোষণা এসেছিলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া যে বাঙালির মুক্তি সম্ভব না সেটি বঙ্গবন্ধু জানতেন। এরপরও চলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ভুট্টোর সঙ্গে সময়ক্ষেপনের আলোচনা।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে সারাদেশের সব মহকুমায় ইপিআরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছিল তার এই বার্তা। বার্তাটি পেয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু ওই তারবার্তার একমাত্র কপিটি এখন রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসংগ্রামী কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর সহধর্মিণী রোকেয়া চৌধুরীর সংগ্রহে, যা তিনি তুলে দিতে চান বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে।
১৯৯১ সালে মারা যান মানিক চৌধুরী। সেই থেকে রোকেয়া চৌধুরী ছোট্ট একটি কৌটায় ভাঁজ করে রেখেছিলেন স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অমূল্য এই সম্পদ। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছে তার। ৭৬ বছর বয়সী এই নারী এখন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। চোখেও তেমন দেখতে পান না। তাই শেষ বয়সে বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে স্বাধীনতা ঘোষণার এই দলিলটি তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পাঁচ দিন ধরে চার পাতার একটি চিঠি লিখেছেন।
রোকেয়া চৌধুরী জানান, মারা যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর তারবার্তাটি তার হাতে দিয়ে যত্নে রাখতে বলেছিলেন মানিক চৌধুরী। সেই থেকে আজ অবধি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এই দলিলটি আগলে রেখেছেন রোকেয়া। মানিক চৌধুরী বলেছিলেন, কোনো অবস্থায় যেন এটি নষ্ট না হয়। একটা সময় এই পত্রটিই মূল্যবান হয়ে উঠবে।
রোকেয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার তো বয়স হয়ে গেছে। বলা যায় না, কখন কী হয়। বঙ্গবন্ধুর মেয়ের হাতে এই ঘোষণাপত্রটা দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব সম্পন্ন হবে। আমি মরেও শান্তি পাব।’
রোকেয়া চৌধুরীর কাছে সংরক্ষিত তারবার্তাটিই এখন পর্যন্ত পাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওই বার্তার একমাত্র কপি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মানিক চৌধুরীর পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তারবার্তাটির একটি ফটোকপি রয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা সারাদেশেই পাঠানো হয়েছিল। এই তারবার্তাটি যারা পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, ওই বার্তায় স্পষ্টতই ঢাকার পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে এবং সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে মানিক চৌধুরীর পরিবারের কাছে সংরক্ষিত ওই তারবার্তাটি ছাড়া আর কোনো কপি কোথাও পাইনি আমরা। তাই ওই কপিটিরই একটি ফটোকপি আমরা জাদুঘরে সংরক্ষণ করেছি।’
তারবার্তাটিতে ইংরেজিতে লেখা আছে- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। ইপিআর ও পুলিশ ঢাকার রাজপথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। জনগণ প্রাণপণে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনগণকে যে কোনো মূল্যে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আহ্বান জানানো যাচ্ছে। আল্লাহ আপনার মঙ্গলে সহায়তা করুন। জয় বাংলা। মুজিবুর রহমান।’
মানিক চৌধুরীর মেয়ে সাবেক সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, তার বার্তাটি মূলত সংরক্ষণ করেছেন আমার মা। এটা এক আশ্চর্য ঘটনা! তিনি স্বর্ণ রাখার ছোট একটি কৌটায় এই তারবার্তাটি সংরক্ষণ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে বাবার একটি ভিডিও আমার হাতে আসে। সেখানে এক জনসভায় বাবা বলেন, সিলেটে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপনের কথা বলেন। সেখানে এই তার বার্তাটি সংরক্ষণ হবে। আমি সাংসদ থাকাকালে এটা নিয়ে সংসদে কথা বলেছি। এখন আমার মায়ের বয়স হয়েছে। তিনি এখন চান এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করতে। এজন্য তিনি নিজ হাতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লিখেছেন। আমরা আশা করছি বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের সময় দেবেন এবং এটি সংরক্ষণে সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।