তুহিন আহমদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কারাগারেই কাটিয়েছেন বহু দিন। সারা জীবনে ২৬ বারে তিনি ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন, যা বছর হিসাব করলে প্রায় ১৩ বছর। সেই কারাজীবনের মধ্যে একরাত তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন বলে জানা যায়।
পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সরকারের অনাচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে সোচ্চার বঙ্গবন্ধুকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের যে কক্ষটিতে তাকে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষটি বন্দিদের পাঠাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে পুরোনো কারাগারটি শহরতলির বাদাঘাটে স্থানান্তরের পর এখন অনেকটা পাঠকশূন্য হয়ে পড়েছে পাঠাগারটি। সেই কক্ষটি ‘বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম’ নামে পরিচিত। যদিও এখন পুরোনো কারাগারে মাত্র ৪০ জন বন্দি রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাকক্ষটি ‘বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম’ হলেও সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি আর কক্ষটির ফটকে তার নাম সাঁটানো ছাড়া আর কোনো কিছু নেই।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আবদুল জলিল বলেন, বঙ্গবন্ধুকে এখানে একরাত বন্দি করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে শুধুমাত্র উনার ছবি রয়েছে। এছাড়া উনার ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র বা কোনো স্মৃতি ওই কক্ষে নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে কোন তারিখে বা কোন সালে বন্দি ছিলেন তার সঠিক কোনো তথ্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়, ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে তিন মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন শহরে আটবার গ্রেফতার হন ও জামিন পান। ওই সময়ের সিলেট সফরে এলে তৎকালীন সরকার তাকে গ্রেফতার করে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখে।
তবে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘কারাগারের রাজনামচা’ শীর্ষক বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বইয়ে সিলেটে বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দির কথা উল্লেখ থাকলেও সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই সেখানেও। বইয়ের ৭৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়, ১৯৬৬ সালের ৯ জুন বৃহস্পতিবার কারাগারে দেখা করতে আসেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। সেখানে উনার মায়ের শরীর খারাপের কথা জানান বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী।
এ সময় বাড়ি গিয়ে অসুস্থ মাকে দেখার একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘এরপর শুরু হলো আমার ওপর জুলুম, যশোরে গ্রেফতার। আমি যখন খুলনা গেলাম মা তখন চলে গেছেন। যশোর থেকে ঢাকা এলাম। ঢাকায় গ্রেফতার করে নিয়ে চলল শ্রীহট্ট। সেখানে জামিন হলো। আবার জেলগেটে গ্রেফতার করে নিয়ে চলল ময়মনসিংহ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সিলেটে কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি থাকার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন কারাগারের সিনিয়র সুপার মো. আবদুল জলিল। তিনি গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সিলেট কারাগারে বন্দির বিষয় নিয়ে তৎকালীন একটি জাতীয় দৈনিকে ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনটি সংগ্রহের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। অবশেষে সেই প্রতিবেদনটি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। ওই প্রতিবেদনে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দির সঠিক সাল ও তারিখটি রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সেটি বলতে পারছি না। ডকুমেন্ট বের করে তারিখটা বলতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেটি টিনশেডের ঘর। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কক্ষটি আগের মতোই রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকবার কক্ষটি মেরামত ও রঙের কাজ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম নামে টিনশেডের এই ঘরটি কারাগারের বন্দিদের জন্য পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পাঠাগারে বই রয়েছে ২ হাজার ৮৮৫টি। নতুন কারাগারে বন্দিদের স্থানান্তরের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পাঠাগারের কারণে বন্দিদের জন্য বইপড়া বাধ্যতামূলকও করা হয়েছিল। তখন বন্দিদের মধ্যে ৫০ জন করে একটি পাঠকচক্র তৈরি করা হয়েছিল। ওই পাঠকচক্রের একজন দলনেতা রয়েছেন। যিনি সপ্তাহের শুরুতে তিনটি বই ইস্যু করতেন। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর একজন করে বই পাঠ করতেন। তবে এখন আর আগের মতো পাঠকচক্র নেই। সিলেট শহরতলির বাদাঘাটে কারাগার স্থানান্তরের পর এখন মাত্র ৪০ জন বন্দি রয়েছেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম এখন আগের মতোই রয়েছে। মিউজিয়ামের ব্যাপারে নতুন কোনো প্রজেক্ট এলে তবেই নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেল সুপার আবদুল জলিল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখতে ও পরবর্তী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে জানাতে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম সংরক্ষণ করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে ধরে রাখতে মিউজিয়ামটি সংরক্ষণ করে রাখা উচিত। কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের পর ওই স্থানে কোনো পরিকল্পনা করে হলেও মিউজিয়ামটি যেন সবার জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত এই কারাকক্ষটি সংরক্ষণের জন্য আওয়ামী লীগের সবার মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছেও বলে জানিয়েছেন আ.লীগ নেতা আসাদ উদ্দিন আহমদ।