ড. মোহাম্মাদ আজিবার রহমান
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু'টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে নিরলসভাবে সংগ্রাম করেছেন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মুক্তির সংগ্রামে তাঁকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় হরতাল পালনকালে ৪৮'র ১১ মার্চ তিনি কারারুদ্ধ হন। ৪৯'র মার্চে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ৪৯'র অক্টোবরে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। বন্দীদশায় '৫২'র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি কারাগারেই অনশন ধর্মঘট পালন করেন। '৫৮'র ১৮ ফেব্রুয়ারী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু এ বছরের ৭ অক্টোম্বর দেশে সামরিক আইন জারির পর তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। তীব্র গণবিস্ফোরণের এক পর্যায়ে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। '৬৫'র পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে বাঙালীদের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু '৬৬'র ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর এক মহাসম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় 'মুক্তির সনদ' ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করেন। আইয়ুব-মোনেম চক্র এটিকে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন বলে দাবি করে এবং ৮ মে তাঁকে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। '৬৮'র ১৭ জানুয়ারি রাতে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ঐ রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল গেট থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালীরা। ফলে ৬৯'র ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে বিপুল গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর অসম সাহসী নেতৃত্বে বাঙালী জাতির দীর্ঘ তেইশ বছরের লড়াই-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযু্দ্ধ। বাঙালী জাতির এই দীর্ঘ লড়াইয়ে '৫২'র ভাষা আন্দোলন, '৫৪'র নির্বাচন, '৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬'র ছয় দফা, '৬৯'র গণঅভু্যত্থান এবং ৭০'র নির্বাচনের পথ পেরিয়ে জাতি উপনীত হয় '৭১'র ৭ মার্চে রেসকোর্সের মিলনমোহনায়। ঐ দিন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে এই ভাষণটিকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ দিন তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাঁর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বাংলার মানুষ। বস্তুত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। তাই তো পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানে আকস্মিকভাবে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর শুরু করে গণহত্যা। পাকহানাদার বাহিনী রাত ১টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন ঘেরাও করে। এ কালরাতের বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেলিফোনে ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, "তাঁরা বাড়ির সামনে এসে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগল, জানালার কাঁচ ভেদ করে শোয়ার কামরার দেয়ালেও গুলি এসে লেগেছিল। আমি চিৎকার করে এগিয়ে এসে বললাম, গুলি বন্ধ কর। আমাকে নিতে এসেছ নিয়ে যাও।" তাঁকে বন্দী করে নেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। দীর্ঘ বিচারের নামে প্রহসন চালানো হয়। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তৎকালীন নামকরা উকিল এ কে বোহিকে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু উকিল নিয়োগে সম্মতি দেননি। কারণ হিসেবে ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, "আমি জানতাম আমাকে ফাঁসি দেয়া হবে। তাই বিচারের প্রহসনে অংশ নিতে চাইনি।" সবশেষে মিয়ানওয়ালী জেলে তাঁর ফাঁসির ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছিল। একটি কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে পারেনি। কারণ সাড়ে সাত কোটি আবালবৃদ্ধবনিতা দিন-রাত তাঁর মুক্তির জন্য দোয়া করেছে। বাংলার ঘরে ঘরে, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায় ও প্যাগোডায় তাঁর অবিলম্বে মুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু ও কামনা করে প্রার্থনা করা হয়েছে। গ্রামবাংলার ধর্মপ্রাণ বহু মানুষ রোজা রেখেছে, নফল নামাজ আদায় করেছে। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, ইন্দিরা গান্ধী থেকে হ্যারল্ড উইলসন পর্যন্ত প্রত্যেক রাষ্ট্রনায়ক ইয়াহিয়া খানকে সাবধান করে দিয়েছেন। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে বাঙালী জাতির এই মহান নেতা দীর্ঘ নয় মাস বন্দী জীবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি থেকেই তিনি সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নামেই এ দেশের অমিত তেজ মুক্তিযোদ্ধারা অসম সাহসিকতার সঙ্গে দুর্ধষ একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে মাত্র নয় মাসের মধ্যে মুক্তি ছিনিয়ে এনেছে, ১৬ ডিসেম্বর '৭১ -এ বিজয় অর্জন করেছে ।
'৭১'র ১৬ ডিসেম্বর থেকে '৭২'র ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই পঁচিশ দিন ছিল বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে বেদনা ও কষ্টের দিন। কারণ দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকস্তানের কারাগারে বন্দী। বাঙালী জাতির প্রাণের দাবি ও গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। '৭২'র ৮ জানুয়ারি মুক্তি দিয়ে তাঁকে পিআইএ বিমানে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু গন্তব্যস্থল অজ্ঞাত রাখায় সবাই ছিল উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবসানের জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনের 'কাবিজেস' হোটেল থেকে ঢাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। লন্ডন থেকে ঢাকার পথে রওনা দেয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী রাজধানী দিল্লীতে তাঁকে কিছুক্ষণ অবস্থানের আমন্ত্রণ জানান। সম্মতি পেয়ে দিল্লী পালামো বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরিসহ ২১ দেশের কূটনীতিক প্রতিনিধিগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ একান্তে আলাপও করেন তিনি।
'৭২'র ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে প্রথম পা রাখেন। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে যান। ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ একটি বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন ঢাকার বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে তখন সারা বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বেতার ও টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের ধারাবিবরণী শুনে এবং ছবি দেখে দেশবাসী আনন্দে বিহ্বল ভাবাবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এই ছিল তাদের মুখের স্লোগান। বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়াদর্ী উদ্যান পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য ছিল। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে ঘিরে ছিলেন মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র নেতাগণ। বিমানবন্দর থেকে সভাস্থল পেঁৗছতে সময় লেগেছিল প্রায় দু'ঘণ্টা। জনতার উত্তাল সমুদ্র ভেদ করে বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে উপস্থিত হন। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে গিয়ে মহান নেতা মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীর বিপুল আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দু'হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অত্যন্ত ভালবাসি।" কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।" কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালী জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নেই।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে। তাই এ দিনটি বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আজ থেকে ৩৮ বছর পূর্বে '৭২'র ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তার লৌহ কারাগারের শৃক্মখল ভেঙ্গে জন্মভূমি তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বস্তুত ৭২'র ১০ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়। তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ১০ জানুয়ারি দিনটি যেমন স্মৃতিবহ ও ঐতিহাসিক, তেমনি অনাগত দিনেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।