এম সিরাজুল ইসলাম
১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ওই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে খুব কমই বলা হয়। খুব সাদামাটাভাবে মুক্তিযুদ্ধের উপরেই সব জোর দেয়া হয়। বারবারই বলা হয়, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ২৫-২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আকস্মিক হামলা— যেটি ইহুদিদের ওপর নািস বাহিনীর হামলার সঙ্গে তুলনাযোগ্য— বাঙালিকে একতাবদ্ধ করে ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং যুদ্ধে সাফল্যস্বরূপ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের উত্থানে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার অংশ অবশ্যই অনস্বীকার্য এবং এটি ১০০ ভাগ সত্য। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে লড়াই করেছিল। পূর্ণাঙ্গ অর্থেই এটি ছিল জনযুদ্ধ, যেটি বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়েছিল এবং বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সফল হয়; কারণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছিল এবং এক নেতার অধীনে নিজেদের জীবন বাজি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য লড়াই করতে বদ্ধপরিকর ছিল, যিনি বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোত্তম ও মহৎ কাজের মতো একটি সম্মিলিত কারণের পেছনে মানুষকে একত্রিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটি এমন এক মুক্তিযুদ্ধ ছিল, আধুনিক ইতিহাসের অন্য যেকোনো মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে যেখানে অধিকসংখ্যক মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। বাস্তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চীন, রাশিয়ার জনযুদ্ধ কিংবা বিশ্বের অন্যত্র নির্যাতনের শিকল থেকে মানবমুক্তির জন্য হওয়া অন্য একই ধরনের যুদ্ধের চেয়ে অকৃত্রিম-নিখাদ ছিল।
তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যতই গৌরবদীপ্ত হোক, এটি এমন এক সময়ে অর্জিত হয়, যখন ওই সময়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিদ্যমান একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি নতুন ও স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনুকূল ছিল না। অন্য কথায়, বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা, দৃঢ় সংকল্প এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপকতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের এক অংশ ভেঙে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ছিল পুরোপুরি বিপক্ষে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো সফল মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পরও অন্য দুটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নির্মমভাবে রহিত হয়, কারণ যেকোনো মূল্যে ও যেকোনো পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কর্নেল ওদুমেগয়োর নেতৃত্বে নাইজেরিয়া থেকে বায়াফ্রা বেরিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নির্মমভাবে দমন করার বিষয়টি বিশ্ববাসী কেবল নীরবেই দেখেছে। কারণ ওই সময়ের আন্তর্জাতিক আইন এটি নিশ্চিত করেছে যে, যেকোনো হুমকির মুখে নিজের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা নিশ্চিতে নাইজেরিয়া যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে শ্রীলংকায় জনতা ভিমুখথি পেরামুনা (জেভিপি) নামক জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু তিন মাসের মাথায় তাও দমন করা হয়।
বায়াফ্রা ও শ্রীলংকা উভয় ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মানুষের সহানুভূতি তাদের পক্ষে থাকলেও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বর্ণিত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগপূর্বক বায়াফ্রান ও জেভিপি সমর্থকদের আন্দোলন দমনে শ্রীলংকা ও নাইজেরিয়ার সরকার সফল হয়।
প্রকৃতপক্ষে, ওই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের অনেক জাতিই মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সর্বজনীন প্রয়োগের হুমকি পেয়ে আসছে। এভাবে যদিও জাতিসংঘ গৃহীত মানবাধিকার সনদে সর্বত্র মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বীকৃত, তবু জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের ভূখাণ্ডিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় আলোচ্য সনদের সর্বজনীন প্রয়োগ স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়।
অনেকেই বলেন, সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না; যদি ভারতের মাটিতে এক কোটি (১০ মিলিয়ন) বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির না করত ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সফলভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আদায় করেছিল এই বলে যে, ১০ মিলিয়ন শরণার্থীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে বিতাড়ন করে পাকিস্তান প্রত্যক্ষভাবে হামলা চালিয়েছে। অতএব ভারত তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যা করছে, সেটি বায়াফ্রায় নাইজেরিয়ান ও শ্রীলংকানদের নিজেদের করা দেশের ঘটনার মতো নয়। বড় কথা, সেই অর্থে ভারতের সাহায্য বা হস্তক্ষেপ আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে ন্যায্যতা পায়নি।
এভাবে এটি ছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সফল হস্তক্ষেপ, যা পাকিস্তান ভেঙে দেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের উত্থান ঘটায়। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার ফলে ভারতের মাটিতে ১০ মিলিয়ন শরণার্থী আশ্রয় না নিলে বাংলাদেশের ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ভাগ্য হতো নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রান ও শ্রীলংকায় জেভিপি সমর্থকদের মতো, যখন ছিল ইউএসএ-ইউএসএসআর দ্বন্দ্ব প্রভাবিত স্নায়ুযুদ্ধের সময়। ১০ মিলিয়ন শরণার্থী আশ্রয় নেয়া ছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের হস্তক্ষেপ করার কোনো কারণ বা অধিকার থাকত না।
কাজেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের সুচতুর কূটনৈতিক কৌশল ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক ভারতীয় পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও এর চূড়ান্ত সফলতার শর্ত তৈরি করে। এটা কোনোভাবেই এ তথ্যকে খাটো করে না যে, ১৯৭১ সালে বাঙালিরা প্রস্তরখণ্ডের মতো এক অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছিল এবং তখনকার আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরূপতা সত্ত্বেও নির্যাতনকারী শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুরো জাতি একত্রিত হয়েছিল, যা নিঃসন্দেহে আমাদের সফল পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। তবে শুধু তা দিয়ে নয় মাসে আমাদের বিজয় সম্ভব হতো না। সম্ভবত সেক্ষেত্রে বিজয় পেতে আমাদের নয় বছর বা তারও বেশি লাগত। ১০ মিলিয়ন শরণার্থী পাঠিয়ে দিয়ে পাকিস্তান সরাসরি হামলা করেছে সম্ভবত ভারত এমন যুক্তির সুযোগ না পেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্নায়ুযুদ্ধের প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রলম্বিত হতো।
ওই সময়ের ভারতীয় ও সোভিয়েত কূটনীতিকদের প্রচেষ্টা এবং ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় যা ঘটেছিল তার প্রতি-বয়ান তৈরিতে পশ্চিমে কূটনীতিকদের ব্যর্থতা সত্যিকার ইতিহাস লেখায় সাহায্য করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এতই মনোযোগী ছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় তার অন্যতম মিত্র কী করছে তাতে খুব একটা দৃষ্টি দেয়নি দেশটি। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ইতিহাসে পাকিস্তানিরা যে অন্যতম নির্মম হতাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা দেশটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল। ফিরে তাকালে দেখা যাবে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ কেবল একটি সফল রাষ্ট্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থা জর্জরিত আজকের পাকিস্তান থেকে সব দিক থেকে ভালো করছে। বলতে গেলে একটি সফল আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে ভালোভাবে রয়েছে বাংলাদেশ।
একবার যখন মুক্ত হলো, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশীদের সফল বৈদেশিক নীতির প্রয়োগে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বমানচিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ ছিল সেখানে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৭১ সালে তার অস্বীকৃতির ভুল থেকে কখনো বেরিয়ে আসেনি। প্রকৃতপক্ষে দেশটির নেতা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাফল্য তাচ্ছিল্যের ক্ষেত্রে হেনরি কিসিঞ্জার এক সাংঘাতিক ভুল করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন— “বাংলাদেশ হবে একটি ‘আন্তর্জাতিক বাসকেট কেস’। কোনো সন্দেহ নেই, দেশটি কখনো অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে না এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা-সহযোগিতা ছাড়া টিকতে পারবে না।’ বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যা অর্জন করেছে, তাতে কিসিঞ্জারের ওই সাংঘাতিক নির্বুদ্ধিতা আর উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না।
ড. কিসিঞ্জারের মুখে চপেটাঘাত করা ওইসব অর্জন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু দ্বারা, যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি আক্ষরিক অর্থে অতি মানবীয় গুণ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অন্য দেশগুলোর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পররাষ্ট্রবিষয়ক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যায় যারা অদ্ভুতভাবে নীরব ছিল, সেসব দেশ একের পর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করে, যেখানে তাকে কিংবা পররাষ্ট্র সম্পর্কে তার সফল নেতৃত্ব ছাড়া স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি খুব একটা সহজ হতো না। এভাবে ১৯৭৫ সালের আগস্টে দেশে দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে বিশ্বের প্রায় দেশই বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেবল চীন স্বীকৃতি দেয়া বাদ রেখেছে। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বাংলাদেশের উত্থানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে এবং দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্ত প্রভাববলয় সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ দুটি ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিও স্বাক্ষর করে।
বঙ্গবন্ধু যখন ক্ষমতায় আসীন ছিলেন, তখন স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাংলাদেশের গর্বের ক্ষেত্র ছিল পররাষ্ট্র সম্পর্ক। স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্মমতার বিরুদ্ধে তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও সাহস এবং বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় সংকল্পের প্রতিফলন ঘটে। স্বল্পসময়ে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে এমনভাবে আবির্ভূত হয় যে, ড. কিসিঞ্জারের তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে খোলা মনে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে স্বাগত জানায়।
চূড়ান্তভাবে চীনের অদ্ভুত বিরোধিতার বাধা অতিক্রমের পর বাংলাদেশ এভাবে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যও হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আলোচনায় বাংলাদেশ সবসময়ই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) হলো সবচেয়ে বৃহৎ গ্রুপ। ১৯৭৪ সালে মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন, যেখানে ব্যাপক উদ্দীপনায় বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুকে ওই সময়ের অন্য মহৎ নেতাদের সমমর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সদস্য করা হয়।
১৯৭৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশকে স্নায়ুযুদ্ধ যুগের ভারত-সোভিয়েত অক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। আলোচ্য অক্ষ আন্তর্জাতিক বাধা ও আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল। তথাপি জিয়ার শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করতে পররাষ্ট্র বিষয়াদি আবারো কেন্দ্রীয় মনোযোগে আসে। রাষ্ট্রপতি জিয়া দ্রুতই পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও কূটনীতি শিখে ফেলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকদের তিনি সাহায্য নেন এবং তাদের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশের জন্য অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে আসেন। তার প্রথম অর্জন হলো চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়, যেটি এক বা একাধিক কারণে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল সেই বিরোধিতার চূড়ান্ত অবসান ঘটিয়েছিল। চীনের ক্ষেত্রে প্রধান মাথাব্যথার কারণ ছিল ভারত-সোভিয়েত অক্ষ, যেটি স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় সংকল্পের বিষয়টি সমর্থন করেছিল।
জিয়ার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থার ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করে। সদস্য হওয়ার ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী আসনে নির্বাচিত হয়। ওই বিজয় খুব আনন্দবহ এজন্য যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশে এশিয়া গ্রুপে জাপানকে পরাস্ত করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে নির্বাচনে ১৯৮১ সালে উভয়ই ৭৫ ভোট পাওয়ার পর টসে বাংলাদেশের প্রার্থী খাজা মোহাম্মদ কায়সার ইরাকের প্রার্থী ইসমাইল কিতানিকে হারান। ১৯৭৫ সালের আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনে বিশেষ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অখুশি হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কে অর্জিত সাফল্যের ক্ষেত্রে কূটনীতিতে রাষ্ট্রপতি জিয়ার অসামান্য কৃতিত্ব ভূমিকা রেখেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেই জিয়া এক্ষেত্রে সফল হন। তার উদ্যোগের মাধ্যমেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গা পানি ভাগাভাগির প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের শাসনের মধ্যকার সময়ে বাংলাদেশ হাজার হাজার মানুষের আত্মবিসর্জনের বাস্তবতা বিশ্বদরবারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়, যারা ১৯৭১ সালে শহীদ হয়েছিল। তারা উভয়ই দেশের অর্জনে পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করেন। দেশ ও মানুষের সর্বোত্তম স্বার্থে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাঙালিকে তুলতে ধরতে তারা উভয়ই আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থই সবসময় প্রাধান্য পায়। অন্তরের গহিন থেকেই দুজনই ছিলেন সত্যিকার জাতীয়তাবাদী।
স্বাধীনতার প্রথম দশকে পররাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিবাচক ভূমিকা আর অব্যাহত থাকেনি। কারণ রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে শুরু হওয়া পরবর্তী দশকগুলোয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অন্য মন্ত্রণালয় ও সিভিল সার্ভিস ক্যাডার কর্তৃক হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়। প্রথম দুই নেতা যা কখনো হতে দেননি। মূলত এরই পথ ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আজকের নবতর পর্যায়ে উন্নীত হতে পেরেছে।
পররাষ্ট্র বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের সফল কর্মযজ্ঞ ছাড়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অগ্রগতি বড় ধরনের হোঁচট খেত এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সূচকে আজকের অর্জনও সম্ভব হতো না।
[ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির]