শঙ্কর প্রসাদ দে
শেখ ফজলুল হক মনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ভাগ্নে। এই অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটির ঐতিহাসিক মূল্যায়ন অবশিষ্ট রয়েছে। মুলত ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই প্রতিভার উম্মেষ। মুক্তিযুদ্ধে একটি স্বতন্ত্র গেরিলা বাহিনীর নাম মুজিব বাহিনী। তাঁকে কেন্দ্র করেই মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো রচিত হয়েছিল। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে যুবলীগ গঠন ও বাকশালের সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মনির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতার আরেকটি পর্ব উম্মোচিত হয়। এই নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর যুদ্ধকালীন গেরিলা সংগঠন মুজিব বাহিনী গঠন ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রবাসী সরকারের সাথে সম্পর্কের বিষয়কে ঘিরে। তবে এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি।
এপ্রিলের প্রথমার্ধে ন্যূনতম হিসেব নিকেশের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে
পক্ষত্যাগী সেনাসদস্যরা, নির্বাচিত সংসদ সদস্য সহ আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব ও ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা একমত হয়েই ১৭ এপ্রিল,৭১ মুজিব নগর সরকার গঠন করেন। কিন্তু মাস দুয়েকের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, যুদ্ধ একেবারে স্বল্প সময়ে শেষ নাও হতে পারে। মূলত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ সম্ভাবনার মধ্যেই প্রবাসী সরকারের কাঠামো নিয়ে ভারতীয়রা পূর্ণ মূল্যায়ন শুরু করে। ষ্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাজউদ্দীনের সরকার নিয়মতান্ত্রিক ও ডানপন্থী দু’ভাগে বিভক্ত। মুলতঃ পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ও পররাষ্ট্র সচিব মাহাবুবুল আলম চাষীকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র একটি গ্রুপের ফর্মূলা অনুযায়ী জীবিত মুজিবকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি কনফেডারেশনের বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। তাদের বক্তব্য ছিল এতে করে স্বাধীনতার কাছাকাছি পৌঁছা যাবে, মুজিবকেও জীবিত পাওয়া যাবে। শরনার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করে এক ধরনের স্বায়ত্বশাসন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এই ধারণাটি বিপজ্জনক মনে হয়েছিল তারা চেয়েছিলেন। প্রয়োজনে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। ২৫ মার্চ সশস্ত্র হামলা গণহত্যার পটভূমিতে প্রায় ত্রিশ হাজার বাঙালি সেনা, নৌ, বিমান, ইবিআর, ইপিআর আর পুলিশ বাহিনীর কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ভাগ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে মর্মে জানা যায় না। প্রিডম ফাইটার তথা এফ এফ নামীয় একটি নিয়মিত সেনাকমান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এদের অধীনে স্বল্প মেয়াদী ট্রেনিং দিয়ে গেরিলার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জেনারেল ওসমানীর নেতৃতাধীন এই সেনাবাহিনীর উপর ভবিষ্যত পুরোপুরি সমর্পণ করা ঝুকিপূর্ণ মনে করেছিলেন মর্মে ধারনা করা যায়। অর্থাৎ প্রবাসী সরকারের ডানপন্থী অংশ এবং সেনাবাহিনীর একাংশ বা পুরোপুরি বিদ্রোহ করলে যুদ্ধের মূল লক্ষ্য অর্জনই ঝুঁকিতে পড়াই স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় একটি তৃতীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় এসে পড়ে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানী ১৮ এপ্রিল একটি অফিসিয়াল চিঠি ইস্যু করে ছাত্রনেতা হিসেবে তোফায়েল আহমদ এবং তার সঙ্গীদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য ছাত্রলীগের কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। এই চিঠিটিই পরবর্তী সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা বিএলএফ খ্যাত গেরিলা বাহিনী সংগঠনের নেতৃত্ব দেন ভারতীয় মেজর জেনারেল সুরজিৎ সিং উবান। তিনি শেখ ফজলুল হক মনি, মিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক এমপি ও ব্যবসায়ী অঞ্জন চৌধুরীর উপর কমান্ডিং এর দায়িত্ব দেন। পরবর্তী শেখ মনিকে বিএলএফের কমান্ডার-ইন-চার্জ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জুন মাসের দিকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মুজিব বাহিনী তথা বিএলএফ পুরোপুরি তাজউদ্দীন এবং জেনারেল ওসমানীর নিয়ন্ত্রন বহির্ভুত একটি সংগঠন। দেরাদুনে এটির হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয়। ১৩০০০ গেরিলার এই বাহিনীর রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং সহ কোন কাজেই প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রন ছিল না।
শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃতাধীন এই ছাত্র নেতারা তাজউদ্দীন সরকারের সাংগঠনিক কাঠামো নিয়েও আপত্তি তুলেছিলেন। তারা একটি যুদ্ধকালীন বিপ্লবী সরকারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের বৃহৎ অংশ মনে করতেন যেহেতু জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৪৬৩ জন সংসদ সদস্যের সবাই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে সেহেতু আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য নিয়মতান্ত্রিক সরকারই উত্তম। ইন্দিরা গান্ধীও এই মতের সমর্থক ছিলেন। পক্ষান্তরে সিরাজুল আলম খানদের যুক্তি ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হলে বিপ্লবী সরকার কায়েমই যুক্তিযুক্ত। তারা এ যুক্তি দেখান যে, এতে করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন পাওয়া যাবে অতি দ্রুত। অবশ্য সিরাজুল আলম খানের এই মতের থেকে অনেকটা ভিন্ন দিকে ছিলেন শেখ মনি। তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের অভিমত ছিল শেখ মনির পক্ষে। এরা মুলত তাজউদ্দীনের মধ্যপন্থী নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছিলেন না। তাজউদ্দীন দলীয় কোন কোরামে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন পাননি এবং তিনি তাঁর চতুর্পাশে শেখ পরিবারের কাউকে রাখেননি। এরপরও যুদ্ধকালীন সময়ে উপরোক্ত চারজনের অধীনে গোটা বাংলাদেশ ৪টি সেক্টরে ভাগ করে মুজিব বাহিনীর কমান্ড বিন্যাস করা হয়। ১নং সেক্টর বা অঞ্চলের কমান্ডার ইন চিফ শেখ মনির অধীনে ন্যস্ত হয় সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম। আবদুর রাজ্জাকের অধীনে ন্যস্ত হয় বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সিরাজগঞ্জ। সিরাজুল আলম খানের অধীনে ন্যস্ত হয় সমগ্র উত্তরাঞ্চল এবং তোফায়েল আহমেদ দায়িত্ব পান কুষ্টিয়া, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পাবনা, ফরিদপুর সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল।
যাই হোক মুজিব বাহিনীর শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের মতাদর্শগত পার্থক্যটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীনিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যে খান সাহেব জাসদের জন্ম দেন। বলা হয়ে থাকে জাসদের বঙ্গবন্ধু ও ভারত বিরোধিতার কারণেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার ভীত রচিত হয়েছিল। অন্যদিকে যুদ্ধকালীন তাজউদ্দিন বনাম শেখ মনি বিরোধটি আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মারাত্মক ফাটলের সৃষ্টি করে। দৃশ্যমান কোন অনৈতিকতা বা দুর্নীতির অভিযোগ না থাকা স্বত্বেও মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দীন আহমদের বিদায় ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলার পেছনে প্রবাসী সরকার ও শেখ মনির বিরোধটি প্রধানত প্রভাব ফেলেছিল মর্মে ধারণা করা হয়।
আবার যুদ্ধের সময় ফিরে দেখলে দেখা যায় খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী অংশটিকে কোনঠাসা করার পর ভারতীয়রা চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ঐ সময় তাজউদ্দিন মুজিববাহিনী নিয়ে ডিপি ধর, পি এন হাকসার ও জেনারেল উবানের নিকট মুজিব বাহিনীকে তাঁর কর্তৃত্বে নিয়ে আসার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু ভারতীয়রা ওই দাবি পাশ কাটিয়ে যান এবং ডিপি ধর অতি দ্রুত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সত্তর সালের খসড়া সামরিক সহযোগিতা চুক্তিটি স্বাক্ষরে সাফল্য দেখান। এরপর পর মিসেস গান্ধী বিশ্ব সফরে বেরিয়ে গেলেন। ফেরার পথে প্যারিসের জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে মুহুর্মুহু হাততালির মধ্যে ঘোষনা করেন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। অবশেষ ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। সবার মতো মুজিব বাহিনীও দেশে ফিরলো।
কিন্তু ভাবলে অবাক হতেই হয় যে, মাত্র তেত্রিশ বছরের যুবক শেখ মনির সাংঠনিক দক্ষতা ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েছিল। একটি গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার- ইন-চিফের দায়িত্ব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের দূর্ভাগ্য এই অসামান্য সাংগঠনিক প্রতিভাধর মানুষটিকে ঘাতকরা পচাঁত্তরের পনেরই আগস্ট চিরতরে স্তব্ধ করে দেয় এবং এ জাতি হারালো তার আরেক শ্রেষ্ঠ সম্পদকে।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট