শঙ্কর প্রসাদ দে
১৯৭৫ সালের কালো রাত্রি ১৫ আগস্ট। সর্বপ্রথম ঘাতকের বুলেট স্তব্ধ করে দিয়েছিল এক অমিত সম্ভাবনাময় প্রতিভা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনির প্রাণ স্পদন। শেখ মনি জন্মেছিলেন ৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯। মাত্র ৩৬ বছরের এই যুবক যে অসামান্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য ও সাংগঠনিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা একাধারে বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব। এই বঙ্গ ব্যক্তিত্বের কর্ম, চিন্তা দর্শনের উপর বিস্তৃত কোন গবেষণা অদ্যাবধি হয়নি বললেই চলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানা দরকার স্বাধীনতা এমনিতে আসেনি। এর পেছনে বহু ত্যাগ, রাজনৈতিক দৃঢ়তা, জাতীয়তাবাদ, দর্শন ও বিপ্লবী মুহূর্তে, কূটনীতি ও সমরনীতি জড়িত ছিল। এই নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে শুধু মুক্তিযুদ্ধে শেখ মনির রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সমরনীতির কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি ১৯৬০ –১৯৬৪ মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বলা বাহুল্য আওয়ামী লীগের এই অংগ সংগঠনটি শাব্দিক অর্থে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিদায় নিয়েছিল। তখনো অবধি চলছিল স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। ৬ দফার মোদ্দা কথা ছিল আমরা নিজেদের নিজেরাই শাসন করবো। পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী শাসক গোষ্টি দ্বারা শাসিত হতে চাই না। এরপর এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি নির্বাচন দিলেন। আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর হলো না। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে শুধু পূর্ব–পাকিস্তানের ক্ষমতা চেয়েছিলেন দু’টি পৃথক সংবিধানের ভিত্তিতে। ২৫ মার্চ চালানো হয় ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম সামরিক হামলা।
রাজারবাগের পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধে নেমে আসার সাথে সাথে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। একটি সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম। অপ্রস্তুত বাঙালি তাৎক্ষণিকভাবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে জয়ী হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। শেখ মনি সহ আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন দলের স্বাধীনতাকামী জনতা আশ্রয় নিল ভারতে। আকাঙ্ক্ষা একটাই সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হওয়া। অতঃপর পাক বাহিনীকে পরাস্ত করা। যেহেতু একটি নির্বাচিত সংসদ বিদ্যমান ছিল সেহেতু ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে ছিলেন। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার খ্যাত প্রবাসী সরকার। শেখ মনি এক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন। তিনি বিপ্লবী ওয়ার কাউন্সিলের পক্ষে ছিলেন। শুধুমাত্র যুদ্ধকালীন ওয়ার কাউন্সিলের উদাহরণ পৃথিবীর বহু দেশে আছে। জার্মানী, ভিয়েতনাম, জাপান, বৃটেন সহ বহু দেশেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়ার কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু নিয়মিত সরকার ছিল না এবং নিজ ভূ–খন্ডের উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দ্বিতীয়ত সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত করতে হলে শুধু ওয়ার কাউন্সিলের পক্ষে ভূ–রাজনীতি, আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও কূটনৈতিক সংগ্রাম মোকাবেলা করা দুরুহ হয়ে পড়তো। এক্ষেত্রে শেখ মনির চিন্তা ছিল, যেহেতু একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল সেহেতু ওয়ার কাউন্সিলকে রাজনৈতিক চরিত্র দেয়া যেত। সশস্ত্র সংগ্রামও অধিকতর শাণিত হতে পারতো। যাই হোক ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওয়ার কাউন্সিল ধারনা গ্রহণ না করায়, প্রবাসী সরকারই গঠিত হয় এবং শেখ মনি তা মেনে নেন। এই মেনে নেওয়ার মধ্যে মাত্র ৩২ বছরের যুবক শেখ মনির রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মিলে। তবে তাজউদ্দিন আহমদ সরকারের সাথে শেখ মনির এই দূরত্ব অব্যাহত থাকে। তাজউদ্দিন শুধু আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছিলেন না। তিনি মস্কোপন্থী কমিউনিষ্ট এবং চীনাপন্থী কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব ও যুবকদের সশস্ত্র সংগ্রামে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন। মস্কোপন্থীরা সদলবলে এলেও চীনাপন্থীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। ধারনা করা হয় শেখ মনি সশস্ত্র সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হবে এমন ধারনা দ্বারা তাড়িত ছিলেন। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ ক্রমশ কমিউনিষ্ট বিপ্লবের পথে ধাবিত হবে এমন আশংকা করেছিলেন। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রাম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে এগোলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য কঠিন হয়ে পড়বে এমন আশংকা মোটেই অমূলক ছিল না। দীর্ঘ মেয়াদী সশস্ত্র সংগ্রাম ও বাম ঝোঁকের গেরিলা যুদ্ধে ভারত নিজ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতোই। তখন স্বাধীনতা অর্জন বিলম্বিত হতোই। তাজউদ্দিন সরকারের গণমুখী গেরিলা রিক্রুট নীতিরও সমান্তরালে শেখ মনি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ কর্মী বাহিনী নিয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব দেন। ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের নিকট প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য হবার যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় প্রায় ত্রিশ হাজার বাঙালি সামরিক সেনা। মুক্তিফৌজের কমান্ডে ছিলো বাঙালি সেনা অফিসাররা। গোটাদেশকে সাতটি সেক্টরে বিভক্ত করে অপারেশনের দায়িত্বে আনা হয়। সামরিক কর্তারা যে কোন মুহূর্তে উচ্চাভিলাষী হতে পারে এবং বিশেষ মুহূর্তে তাজউদ্দিন সরকারের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে এই আশংকা বা রাজনৈতিক হিসেব থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেখ মনির প্রস্তাব গ্রহণ করে শেখ মনির নেতৃত্বে গঠন করেছিলেন মুজিব বাহিনী। এই গেরিলা বাহিনী স্বাধীনতার প্রশ্নে যেমন ছিল আপোষহীন তেমনি কট্টর বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিক। যদিও শুরুতেই মুজিব বাহিনীর একটি বড় অংশ চেয়েছিল বাংলাদেশ হবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ মনির মতের অনুসারী হলেও অপর শীর্ষ নেতা সিরাজুল আলম খান ছিলেন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে। দেশ স্বাধীন হবার অল্প সময়ের মধ্যেই সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরাই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগানে গঠন করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এই জাসদই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনি হত্যাকান্ডের পটভূমি তৈরী করেছিল।
যাই হোক মুজিব বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে প্রবাসী সরকার ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার বহু ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষেরও ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাসের বিচারে ঐসব ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল এবং ক্ষেত্র বিশেষে মুজিব বাহিনীর সুনামও বহুক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়ায় ক্যাপ্টেন করিম ও ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন চৌধুরী হত্যাকান্ড অন্যতম। এই স্বপন চৌধুরীই স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাব উত্থাপন করে রীতিমত জাতীয় আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। তারা মূলত সিরাজুল আলম খান গ্রুপের সমর্থক ছিলেন। স্বাধীনতার পর অতি দ্রুত এই বিরোধ প্রকাশ্যে এসে পড়ে।
শেখ মনির নেতৃত্বে তোফায়েল আহম্মদ ও আবদুর রাজ্জাক হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর সরকারের সমর্থক। সিরাজুল আলম খান সাহেবের অনুসারীরা হয়ে উঠেন কট্টর বঙ্গবন্ধু বিরোধী। আর্থ–সামাজিক বাস্তবতা হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য আওয়ামীলীগ যেমন বিপ্লবী কমিউনিস্ট দল ছিল না তেমনি জাসদও প্রশিক্ষিত কমিউনিষ্ট পার্টি ছিলনা। জাসদের মূল লক্ষ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করা। শেখ মনিকে চেয়ারম্যান করে ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার পচাঁত্তরে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। প্রশ্ন উঠবে আপাদমস্তক জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব শেখ মনি কি সমাজতন্ত্র কায়েম করতে পারতেন। এখানে গুরুতর ভুল আছে। সমাজতন্ত্রের অনেক উপাদান থাকলেও রাজনৈতিক দল বাকশাল যেমন বিপ্লবী পার্টি ছিল না তেমনি বাকশাল কর্মসূচি বলা যাবে একটি জাতীয় ঐক্যমতের প্রতিভু, জাতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শ্রেণি, পেশা, রাজনৈতিক দল এমনকি সামরিক বাহিনীরও প্রতিনিধিত্ব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি ধরে একটি অর্থনৈতিক সাম্য ও উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল মাত্র। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর প্রথম নেতৃত্ব এবং বঙ্গবন্ধুরই ভাবশিষ্য শেখ মনি ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা ছিল শেখ মনিই পারবেন, সবচে সুবিধাভোগী সামরিক বাহিনী ও গ্রামীণ জোতদারদের লাগাম টেনে ধরে কৃষক শ্রমিকের উপর শোষণ প্রক্রিয়া উৎখাত ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে। ঘাতকরা শত্রু চিহ্নিত করতে ভুল করেনি। তারা বুঝেছিল একটি প্রগতিশীল শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ার যোগ্য কারিগর এই শেখ মনি। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর আগেই তারা শেখ মনিকে হত্যা করে। তাঁর গণমুখী এই রাজনৈতিক দর্শন শোষক শ্রেণীকে কতটুকু শঙ্কিত করেছিল এতেই তা পরিষ্কার। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এই জাতীয়তাবাদী দর্শন শেখ মনিকে বাংলার ইতিহাসে করে রাখবে অক্ষয় অমর।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট