হাসান মাহামুদ :
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’
সেই ‘পুরাতন সমাজব্যবস্থা’ উপড়ে ফেলে ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ গড়ার পরিকল্পনায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং কূটনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার ঘটনা থেকে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে দেশে ফেরেন।
১৯৭২ সালের এই দিনে অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছান এবং নতুন দেশের স্বীকৃতির জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানান। সে হিসেবে রোববার ‘বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পদযাত্রার ৪৫ বর্ষপুর্তি’ বলা যায়। যদিও আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৪৬ বছর।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এবং কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের কূটনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশের কূটনীতির মূল দর্শন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ সেই দর্শনে এখনো চলছি আমরা। আর তাইতো আমাদের সাম্প্রতিক অর্জন অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ।’
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এই সময়ে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো যখন একে অন্যের বিরুদ্ধে, তখন একই সঙ্গে সব প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখা কূটনীতিতে বেশ কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম সফল একটি দেশের উদাহরণ দাঁড় করিয়েছে। এশিয়া মহাদেশের দুই বড় রাষ্ট্র ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও বাংলাদেশের কৌশলগত মিত্রতা রয়েছে দুই দেশের সঙ্গে। চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফর করার এক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন। দুই নেতাই বড় বড় অঙ্কের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। প্রায় দুবছর হয়ে গেছে, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও জাপানের সঙ্গে পুরনো বৈরিতা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। কিন্তু এ অবস্থাতেও বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে।
আবার ২০১৫ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল ও সিরিয়া ঘিরে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ নতুন মাত্রা পায়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে উভয় দেশের সঙ্গেই। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়া। সম্পর্কের খানিক টানাপোড়েনের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক যুগ ধরে ঝুলে থাকা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে গত আট বছরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কেবল সমাপ্তিই হয়নি, সম্পর্কের উচ্চতা পৌঁছেছে আরো ওপরে। ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় প্রকল্পে নতুন করে অর্থায়ন করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। গত বছর বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম নিজ থেকে এসেছেন বাংলাদেশ সফরে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন করে ৩০০ কোটি ডলার অর্থায়নের।
এসব বিষয়ের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে নীতি বঙ্গবন্ধু সরকার নিয়েছিলেন, তা প্রতিষ্ঠায় আমরা সমান্তরাল রেখায়(প্যারালাল লাইন) আছি।
আমাদের ভাষা আন্দোলন এখন বিশ্ব স্বীকৃত। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’। এই তো কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিলা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। কূটনীতিক সাফল্যে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি বজলুল হুদা এবং শাহরিয়ার রশিদকে দেশে ফিরিয়ে আনা গেছে। সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক জয় পেয়েছি আমরা। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়েছে। ভারতের সাথে সীমানা চিহ্নিতকরণ। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রাপ্তি এবং তিনবিঘা করিডোর উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে ছিটমহলের সাথে মূল ভুখণ্ডের সংযোগ স্থাপন সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য।
এছাড়াও আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ। ঢাকায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে আমরা অটিজম সম্মেলন করেছি। নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সাউথ-সাউথ পুরস্কার অর্জন করেছেন। শিশু মৃত্যুর হার কমানোর অসামান্য সাফল্যে জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা প্রদান, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশ সহ-সভাপতি নির্বাচিত, বিদেশে ৯টি নতুন দূতাবাস খোলায় সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার, শেখ হাসিনার শান্তির মডেল জাতিসংঘে গৃহীত, বিশ্বের ৪৬টি দেশের আন্তঃআঞ্চলিক জোট এশিয়া-ইউরোপ মিটিং এর ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত ৯ম শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা লাভ- এসবই আমাদের মোটা দাগের কূটনৈতিক সাফল্য।
আমরা হলফ করে বলতে পারি, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতা অর্জনের পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকাই মূল নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। আমরা চাই জাতীয় নেতৃত্বের এই দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং গঠনমূলক মৈত্রীপ্রিয় দৃষ্টান্তমূলক কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকুক। বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাক।
লেখক: সাংবাদিক।