যে মুজিব চিরদিন প্রজন্মের চেতনার উৎস


বাঙালীর জীবনে আবারও এসেছে সেই শোকের আগস্ট মাস। আগস্ট মাসটি এলেই নানা বেদনার চিত্র আমার মানসে ফুটে ওঠে। এই মাসটি বাঙালির ইতিহাসে একটি কলংকের মাস।

পনেরোই আগস্টের সেই কালরাতে যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, তারা চেয়েছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দিতে। তারা চেয়েছিল ভেঙে দিতে একটি উন্নয়নশীল জাতির মেরুদণ্ড। আজ পয়ত্রিশ বছর পর সে প্রশ্নটিই আসে, সেই ষড়যন্ত্রকারীরা কতোটা সফল হয়েছে।

সফল যে তারা হয়নি তা বলা যাবে না। তারা যা চেয়েছিল ,তার অর্ধেকেরও বেশি তারা পূরণ করতে পেরেছে। হয়তো আরো জঘন্য রূপ নিলে বাংলাদেশ বর্তমান পাকিস্তানের মতো রূপ নিতো। তা নেয়নি। কোনো লাল মসজিদ ট্র্যাজেডি যদিও বাংলাদেশে সংঘটিত হয়নি তবুও ১৭ আগস্টের বোমা হামলার মতো মারাত্মক কাজ তারা করতে পেরেছে বাংলাদেশে। গোটা দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলার মাধ্যমে। আদালত প্রাঙ্গণে বিচারক হত্যার মাধ্যমে। বাংলাভাই, শায়খ রহমান , মুফতী হান্নান , মওলানা মহীউদ্দীন তৈরির মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে যে পরিবর্তনটি ষড়যন্ত্রকারীরা করতে পেরেছিল, তা কি ঠেকানো যেতো না? আমার বারবার যেন মনে হয় তা ঠেকানোর পথ প্রশস্থ ছিল। কিন্তু যারা সেদিন সশস্ত্র ক্ষমতাবান ছিলেন তারা ‘রিস্ক’ নিতে চাননি। কেন ‘রিস্ক’ নিলেন না, সে প্রশ্নটি আমি আজো করি। বঙ্গবন্ধু যখন আক্রান্ত হন তখন দেশে একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী বহাল ছিল। সেনা, নৌ, বিমান তিনটি বাহিনীই ছিল জাগ্রত। যারা এই হীন অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল এরা ছিল বিপথগামী কিছু সেনা সদস্য। প্রশ্নটি হচ্ছে এই, সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যার পরে হলেও সেনাবাহিনী কেন তাৎক্ষণিক ঐ কতিপয় চক্রান্তকারী সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিলো না? কেন সেদিনের সেনাবাহিনী প্রধান কে এম শফিউল­াহ তার বাহিনী নিয়ে জাতির পক্ষে, ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন না?

যদি তেমনটি হতো তাহলে হয়তো আরো কিছু রক্তপাত হতো। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হতো। জাতির জনক বেঁচে না থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ অনুসারী তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সামাদ আজাদসহ অন্য নেতারা সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা পেতেন। খন্দকার মোশতাকের মতো নর্দমার কীটরা রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার স্বপ্ন ভণ্ডুল হয়ে যেতো। কে এম শফিউল­াহ যে জবাবই দিন না কেন, তিনি যে ভুলটি করেছিলেন­ তার মাশুল গোটা জাতিকে দিতে হচ্ছে আজো তিলে তিলে। জাতির এতোই দুর্ভাগ্য, আজ পয়ত্রিশ বছর পরও ঘাতকদেরকে প্রেতাত্মা ধাওয়া করছে গোটা জাতিকে।

আশার কথা , বর্তমান মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতির জনকের খুনীদের একাংশের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এখনও একটি খুনী অংশ বিদেশে পালিয়ে আছে। এদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা খুবই জরুরী কাজ।

বিশ্বের কোনো দেশে, কোনো ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের বিচারকর্ম বন্ধ কিংবা তা নিয়ে গড়িমসির ঘটনা বোধহয় আর নেই। বাংলাদেশের যিনি স্থপতি, যিনি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার জন্য জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন­ তার হত্যাকাণ্ডের বিচারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় আইন। তথাকথিত ইনডেমনিটি বিলের নামে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি বাধাগ্রস্থ করতে সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। একজন মহান নেতার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধটুকু থাকলে কোনো দল বা নেতা তা করতে পারে?

বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতির চেয়ে জঘন্য হীনমন্যতা বোধহয় আর কিছু নেই। এসব করার পেছনে প্রকারান্তরে একটি কারণ ছিল। আর তা হলো ঘাতকচক্রকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা। সে আশায় আজ যে গুড়েবালি পড়েছে­ তা হচ্ছে তাদেরই কৃতকর্মের ফল। আজ বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে বলছেন, তার ছেলে তারেক- কোকো নাকি কোনো অপকর্মই করে নি।

কিন্তু খালেদা জিয়া ভুলে যাচ্ছেন তারেক রহমান তার সন্তান হিসেবে, তিনি তারেককে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কোনো মহৎ রাজনীতিক কখনোই রাষ্ট্রীয় রাজনীতিকে পারিবারিক গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে চান না।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে বঙ্গবন্ধুকে যতোটা অবমূল্যায়ন করতে চাননি, খালেদা জিয়া এবং তার শাসনামলে তা করা হয়েছে বহুগুণে। শেখ মুজিবের সমান্তরালে অন্য কোনো নেতা দাঁড়াবেন কিনা­ তা মহাকালই বলবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে­ এই শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় এবং তারও অগ্রজ বেশ কজন নেতা পাকিস্তান থেকে বের হয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র গঠনের নেতৃত্বটি দিতে পারেননি। আর পারেননি বলেই শেখ মুজিবকে এগিয়ে আসতে হয়েছিল। এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন। আর সে জন্যই তিনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

আজ যারা শেখ মুজিবের পাশাপাশি ‘জাতীয় নেতা’র সনদ লাগিয়ে অন্যদের ছবি রাখার কথা বলেন­ তারা আদৌ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির অভ্যুদ্বয় চেয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। আমরা লক্ষ করি, জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা কামাল আতাতুর্ক কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বা তুরস্কে একজনই। তার সঙ্গে অন্য নেতাদের তুলনামূলক আলোচনায় কখনোই যান না সেসব দেশের নাগরিকরা। অথচ বাংলাদেশে শেখ মুজিবের কাতারবন্দী করার জন্য নামের তালিকা শুধু বেড়েই চলেছে। একসময় হয়তো দেরিতে কর দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ করার নেতানেত্রীরাও শেখ মুজিবের পাশাপাশি আসনে নিজেদের আশ্রয় খুঁজতে উদ্যত হবেন।

কিন্তু তাই বলে কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে ফেলা যাবে? না যাবে না। একটি বিষয় অনেক চরম ক্রান্তিকালেও প্রমাণিত হয়েছে, যারা প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর চেতনা লালন করেন তারা ভোগবাদী নন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্বল মামলাগুলোতে তার জামিন প্রাপ্তি এটাও প্রমাণ করছে। তিনি কিংবা তার সহদোরা শেখ রেহানা যদি ভোগবাদীই হতেন, তবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের তাদের একমাত্র বাড়িটি ট্রাস্টে দিয়ে দিতেন না।

বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠের যে অমিত তেজ তা ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা ’৭৫ সালে করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। বোমা মেরে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে যে জঘন্যতম হামলা করা হয়েছিল, তা ছিল সেই ধারাবাহিকতায়। এরও সুবিচার বাংলার মাটিতে এখন পর্যন্ত হয়নি। এই শোক বহন করেই চলেছে বাংলার মাটি, বাংলার নদীনালা।

ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনকের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে সরকারি উদ্যোগ নিয়েছিল।

এটাও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জামাত- বিএনপির।

জাতির জনকের স্বপ্ন গুলো পূরণে মানুষের ঐক্য দরকার।

আমরা এই প্রত্যয় বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে লক্ষ করছি, আগস্টের শোক ও বেদনাকে চিত্তে ধারণ করে তারা সোনার বাংলা গড়তেই এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের একটি শক্তিশালী বাহুর মতোই মুজিব আবির্ভূত হয়েছিলেন বাঙালি জাতির জন্য। সেই শেখ মুজিব এখন চিরনিদ্রায় শায়িত তার জন্মস্থান সবুজ টুঙ্গিপাড়ায়। তার শয্যাপাশে গিয়ে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা নিজের শৌর্য, শক্তি এবং রক্তস্রোতেরই সন্ধান করে। কোনো অপশক্তিই এই গতিধারা থামাতে পারবে না। আলোকিত মানুষের জীবনকর্ম, আরেকটি জীবনকে আলোকিত করে। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা হয়েই থাকবেন চিরদিন।

বিষয়টি ভাবলে খুবই দু:খ পাই, বাংলাদেশের রাজনীতিক পরিচয়ধারীরাই হীনস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শেখ মুজিবের স্বপ্নগুলোকে নস্যাৎ করতে বিভিন্ন সময় নানাভাবে তৎপর হয়েছেন। এইসব মতলববাজরাও একদিন আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হবেন আগামী প্রজন্মের হাতেই। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগই হবে বাঙালি প্রজন্মের পাথেয়।

(নিউইয়র্ক , ১১ আগস্ট ২০১০)

-------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ১৩ আগস্ট ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত

তথ্য সূত্র: 


ফকির ইলিয়াস: জন্মস্থান - সিলেট, ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬২। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, জার্নালিস্ট। তার লেখা গানের সংখ্যা সহস্রাধিক। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২টি। বর্তমান আবাস স্থল: নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

SUMMARY

2073-1.gif