ইনানীতে ‘বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস’ নিয়ে গালগল্প!

সায়ীদ আলমগীর

বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ইনানীর চেংছড়িতে ২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসনের লাগানো সাইনবোর্ড। এখানে উল্লেখিত তথ্যাদি নিয়ে বিভ্রান্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রজন্ম। কল্পনাপ্রসূত এক গালগল্প নিয়ে চলছে স্মৃতি জাদুঘর গড়ার উদ্যোগ।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন (জরুরি অবস্থা) জারি করেন। এর চারদিন পর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হয়। সেই সময় টানা ১৪ মাস কারান্তরীণ ছিলেন তিনি।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার কয়েক মাসের মাথায় গ্রেফতার হয়ে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত কারাগারেই কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিনকাল।


ইতিহাস এমনটি বললেও ১৯৫৮ সালের জরুরি অবস্থা কিংবা ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে কক্সবাজারের ইনানীর তৎকালীন গহিন বন চেংছড়িতে বঙ্গবন্ধু ‘অজ্ঞাতবাসে’ ছিলেন এমন একটি মৌখিক ইতিহাস স্থায়ী রূপ পাচ্ছে।

২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট এ বিষয়ে প্রথম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম সারির গণমাধ্যম দৈনিক জনকণ্ঠ। এ নিয়ে হৈ-চৈ পড়ে যায়। এরপর অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলো প্রতি বছরই এনিয়ে একেক ধরনের গল্প প্রচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।

২০১০ সালে দৈনিক কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় যোগ দেন জনকণ্ঠ পত্রিকার সেই প্রতিবেদক তোফায়েল আহমদ। ওই বছর ১৭ মার্চ ‘ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন তিনি কালেরকণ্ঠে প্রকাশ করেন। সেখানে লেখেন, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান রাজনীতির উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে। এ সময় ভিন্ন একটু সময় কাটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কক্সবাজারে এসেছিলেন। উক্ত সংবাদে জনৈক লোকমান হাকিমকে (যিনি পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাস্টার নামে পরিচিতি পান) তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে তার উদ্ধৃতি দিয়েই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

অথচ কক্সবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬১ সালের শেষের দিকে। এ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্তফা (বর্তমানে জেলা বারের আইনজীবী)।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু ইনানীতে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে এসেছিলেন। সামরিক শাসনের সময় নয়। এটি মিথ্যাচার ও কল্পনাপ্রসূত। এ গল্প তাকে (বঙ্গবন্ধু) মর্যদাহানি ও ছোট করা হয়েছে। এটি কিছু মানুষের দূর্বিসন্ধি। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য হয়ত তারা মনগড়া ইতিহাস তৈরি করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হলেও চেংছড়ির গালগল্পের ইতিহাসে দেখলাম আমাদের আগেও লোকমান হাকিম নামে একজন ছাত্রলীগ নেতা রয়েছেন! অথচ তাকে চিনতামও না।

অ্যাড. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ১৯৬১ সালে আমি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হই। এরপর থেকে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক আড্ডায়ও বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে এসেছিলেন তা শুনিনি। ১৯৫৮ সালে যেখানে ছাত্রলীগের কার্যক্রমই ছিল না, সেখানে লোকমান হাকিম কিভাবে ছাত্রলীগের নেতা হন?

তার মতে, যদি বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে থাকতেন তবে তার কর্মীদের মেরে ফেলা হতো। বরং তিনি (বঙ্গবন্ধু) কর্মীদের গোপনে রেখে নিজেই প্রকাশ্যে রাজনীতি করতেন।

একই গল্প নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার বর্তমান প্রতিবেদক এইচ এম এরশাদ ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছেন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার এসেছিলেন। একই প্রতিবেদক ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট আবার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময় কক্সবাজার এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। 
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে কক্সবাজারের জেলা সংবাদদাতার বরাতে এ সংক্রান্ত প্রচার হওয়া দুটি প্রতিবেদনে দুই ধরনের তথ্য প্রচার পায়।

প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে বন্ধ করল প্রকাশ্য রাজনীতি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চালিয়ে গেলেন রাজনৈতিক তৎপরতা। স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিলেন। বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করতে এলেন ফেলারম চাকমার বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুকে এ বাড়িতে নিয়ে এনেছিলেন সেই সময়ের ছাত্রলীগ নেতা লোকমান হাকিম। এখানে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বেশির ভাগ সময় কাটাতেন কাঁঠাল গাছের নিচে।

পরের বছর প্রচার করা দ্বিতীয় প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আত্মগোপনে বা হুলিয়া এড়াতে নয় এখানে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন গোপন বৈঠক করতে। একটি আম গাছের নিচে তিনি সময় কাটাতেন। (প্রতিবেদন দুটি সংরক্ষিত রয়েছে)

এসব গল্পের সূত্র ধরে একেকজন একেক রকম কল্পনাপ্রসূত তথ্য উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস নিয়ে স্ব স্ব গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার করে আসছেন।

এদিকে যার কাছে বঙ্গবন্ধু আশ্রিত ছিলেন বলে গল্প বলা হয়েছে সেই ফেলারাম চাকমার নাতি রবি অং চাকমা ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘর প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ’ আবেদনে উল্লেখ করেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেংছড়িতে আত্মগোপনে এসে আমাদের কাছে ছিলেন। 

আর প্রচার পাওয়া ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসনও উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-বিজড়িত হিসেবে ‘চেংছড়িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের। ইতোমধ্যে ইনানী মৌজায় ৫৭০৭ দাগে বসবাস করা বেশকিছু পরিবারকে উচ্ছেদ করে পাঁচ একর জমিও দখল সম্পন্ন হয়েছে। 

ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বয়ান আরও ভয়াবহ। ২০১২ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের বৈঠকে ২১ নাম্বার সিদ্ধান্তে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু উখিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ে তাকে আপ্যায়ন ও আশ্রয়দানকারী লোকমান হাকিম ও ছকিনা বেগমকে শুভেচ্ছা উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যা ৭ মার্চ ০৫.২০.২২০০.১১০.১০.০০৫.১৩.১৭৮ স্মারকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পাঠানো হয়। পরবর্তী বছরও একই সময়ে একই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে চিটি দেয় জেলা প্রশাসন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস এবং ১৪ নভেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে পৃথক দুটি প্রস্তুতি সভায় তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজি আবদুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ইনানীর চেংছড়িতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থান সংরক্ষণ বিষয়ে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত মতেই সামনে এগোচ্ছে জেলা প্রশাসন।

কমিটির সদস্য সাংবাদিক মুহাম্মদ আলী জিন্নাত বলেন, ৮ আগস্ট সর্বশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে শ্রেণি পরিবর্তন করে বন বিভাগের পাঁচ একর জমি জাদুঘরের জন্য করে নিতে প্রধানমন্ত্রী দফতরে আবেদন পাঠানো হবে। ইতোমধ্যে ওই এলাকায় বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করে জায়গাটি দখলে নিয়ে একটি পাইলট প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে। এটি রক্ষণাবেক্ষণে একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দেয়া হবে।

কোন ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে এটি করা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ছখিনা বেগম ও লোকমান হাকিমের দেয়া তথ্যে এটি করা হচ্ছে। ১৯৫৮ সালের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হলে তিনি চেংছড়ির অজ্ঞাতবাস নিয়ে প্রথম প্রকাশ করা রিপোর্ট অতিরঞ্জিত উল্লেখ করে বলেন, বিষয়টি আরো গভীরভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা বাঞ্চণীয় হবে।

এসব বিষয় গোচরে আসার পর কক্সবাজার সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও চেংছড়ির পার্শবর্তী মনখালীর বাসিন্দা ওয়াহিদুর রহমান রুবেল এলাকার বয়োবৃদ্ধ মুরব্বিদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেন। কারও কাছে চেংছড়ি ইতিহাসের সত্যতা না পেয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বসেন। দু’জন মিলে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন ও ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য পর্যালোচনা করেন। ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির পর ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে টানা ১৪ মাস কারান্তরীণ ছিলেন। আসল বিষয় তুলে আনতে কথা বলা হয় কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। তার মতে, ইতিহাস হবে আবেগ বর্জিত, বস্তুনিষ্ঠ। কারও মুখের কথায় সাহিত্য হতে পারে, ইতিহাস নয়।

রেকর্ড বলছে, ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইনানীতে এসেছিলেন। ওই সময় হুলিয়া জারির মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলনা। সামরিক শাসন জারি হয় ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন ১২ অক্টোবর।

কিন্তু মৌখিক ইতিহাসের বয়ানকারী মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাস্টার জোর দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন জারি কালেই হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে ইনানী আসেন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্য রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বার বার তাকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু অনেক বার কক্সবাজারে আসেন। কিন্তু তিনি ইনানীর চেংছড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন বলে যে ইতিহাস প্রচার করা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয়। কারণ যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকে বির্তকিত করতে এ ধরনের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে।

এটি বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের শামিল ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে কক্সবাজার এসে ইনানীর রেস্ট হাউজে উঠেছিলেন। পরিদর্শন বইতে সফরসঙ্গীসহ তার স্বাক্ষর রয়েছে। তাই সংরক্ষণ যদি করতে হয় ইনানী রেস্ট হাউসকে স্মৃতি জাদুঘর করা যেতে পারে।

প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়তোষ পাল পিন্টু বলেন, আত্মগোপনের বিষয়টি হাস্যকর। এই মিথ্যা ইতিহাসটি কিছু কিছু মানুষের অভিসন্ধি। তাই প্রকৃত ইতিহাস জেনে স্মৃতি সংরক্ষণ করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো হবে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সময়ে যারা রাজনীতি করেছিলেন তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা উচিত। আমার মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্য বেশি প্রেম দেখাতে গিয়ে অতি ছোট করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও এগিয়ে আসতে পারেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু কোনো সময় আত্মগোপনে ছিলেন না। এছাড়া সামরিক শাসন জারির পর তো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। একই মানুষ একই সময় দুই জায়গায় থাকতে পারেন না। চেংছড়ির কাহিনীটির সত্যতা আরও যাচাই করতে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বিষয়টি পার্টির ফোরামে কখনও আলোচনা হয়নি এবং প্রশাসনের কাছে দাবিও তোলা হয়নি। এখানে একটি মিথ্যা ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হউক তা আমরা চাই না। যদি মিথ্যা ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে জেলা প্রশাসনকে দায়ভার নিতে হবে। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখবন্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে কারান্তরীণ হন। একজন মানুষ একই সময়ে কারাগারে ও কক্সবাজারে অজ্ঞাতবাসে থাকতে পারেন না। জেলা প্রশাসনের স্বাক্ষরেই জাদুঘরসহ সমস্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। তাই আমি অনুরোধ করব এটি বাস্তবায়নের আগে প্রকৃত ইতিহাস জেনে নিতে হবে।

ইনানীর গহিন বন চেংছড়িতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস নিয়ে ২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট জনকণ্ঠে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশকারী পত্রিকাটির তৎকালীন জেলা প্রতিবেদক বর্তমান কালেরকণ্ঠ প্রতিবেদক তোফায়েল আহমদ বলেন, ইনানী রেস্ট হাউজে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষরটা বঙ্গকন্ধুর ইনানীতে অবস্থান নিশ্চিত করে। কিন্তু চেংছড়িতে ‘অজ্ঞাতবাস’ তথ্যটি গালগল্প। আমার বাবা ও লোকমান হাকিম মাস্টার এবং ছখিনাসহ এলাকার কিছু মুরব্বির মাধ্যমে এ কথাটি আমি জানতে পারি। সেভাবেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। আমার কাছে দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন চেংছড়ির বিষয়টি নিয়ে দালিলিক কোনো প্রমাণ তার কাছে নেই স্বীকার করে বলেন, আমি পূর্বের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছি। তবে এটি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে ভূমিকাতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ১৯৫৮ সালে ১২ অক্টোবর তৎকালীন সামরিক সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এবারে প্রায় ১৪ মাস জেলখানায় বন্দি থাকার পর তাকে মুক্তি দিয়ে পুনারয় জেল গেটে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদনের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

এরপর ১৯৬৬ সালে নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ মিটিং করে ঢাকায় ফিরে এসইে ৮ মে মধ্যরাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। দেশের মানুষের ন্যায্য দাবি তুলে ধরে জনসভায় বক্তৃতা দেয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে সরকার। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে (পৃষ্ঠা নং-৬)।

একই তথ্য উল্লেখ রয়েছে, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পৃষ্ঠা-২৯৪), মহাপুরুষ (পৃষ্ঠা নং-৩৩ ও ৮৯), মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬ (পৃষ্ঠা নং-৭১ ও ১০৪), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ও জীবনধারা-১৯২০-১৯৭৫ (পৃষ্ঠা-৫৭ ও ১১৫) বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পৃষ্ঠা-৪০-৪৫), বঙ্গবন্ধু : কারাজীবন ও সংগ্রাম স্বাধীনতা (পৃষ্ঠা-৪০-৪৮), বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি (পৃষ্ঠা-৩৬), বঙ্গবন্ধুর হত্যার দলিল (পৃষ্ঠা-২৬৮-৭০), স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় : বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য-১৯৪৭-১৯৭১ (পৃষ্ঠা-৫৭), আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি (পৃষ্ঠা-৩০,৫৩-৫৫), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড অনুমোদিত সিলেবাসের আলোকে ‘পৌরনীতি ও সুশাসন (পৃষ্ঠা-৫৯), বঙ্গবন্ধু কোষ (পৃষ্ঠা-৩৯২-৯৫) বইয়ে।

SUMMARY

2071-1.jpg