রাজনীতিতে মিথ্যার নৈপুণ্য

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার সময় সুযোগের বাতাবরণ দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটা ছিল মিথ্যা ঘোষণা। এরপর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে বুঝতে পারলেন ২৭ তারিখকে অক্ষুণœ রেখে প্রচারণা চালালে তেমন সুবিধাজনক হয় না, তাই ক্ষমতার জোরে ১ দিন এগিয়ে এনে বলতে শুরু করলেন, জিয়া ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন ঘোষণাটি তিনি নিজ কানে শুনেছেন।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি, পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন- এমন অনৈতিহাসিক মিথ্যা প্রচারণা অনেকদিন পর্যন্ত চলেছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে এই মিথ্যা চলতেই থাকত।

বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে, রক্ষীবাহিনী নিয়ে, বাকশাল গঠন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। থাকতেই পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তি করেছিলেন, এই প্রচারণা ছিল জঘন্য মিথ্যা। অনেক মিথ্যা অপবাদ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়েছিল। তার ভাবমূর্তির ওপর অনবরত কর্দম নিক্ষিপ্ত করা হচ্ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে এতদিনে বঙ্গবন্ধুর প্রাপ্য মর্যাদা অনেক মিথ্যার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যেত। এ দেশের অনেক বড় বড় বিদ্বান, পণ্ডিত, তাত্তি¡ক বঙ্গবন্ধুকে ঈর্ষা করেন। ড. মুনতাসীর মামুনের ভাষায় ‘শেখ মুজিব লুঙ্গি পরাদের নেতা’- হয়তো এজন্যই।

বঙ্গবন্ধু ডক্টরেট নন, ব্যারিস্টার নন, ভুট্টোর মতো জমিদার, সামন্তবাদী নন, লেনিনের মতো তাত্তি¡ক নন। তাঁর ছিল সাংগঠনিক প্রতিভা, ছিল বাঙালিদের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ছিল সাহসের বিস্তৃত বক্ষপট। ছিল সরলতা। মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে সরলতা ছিল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মধ্যেও সরলতা ছিল। খাজা নাজিমুদ্দিন কামরুদ্দীন আহমদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘ঐব রং ধ ঝঃৎববঃ খবধফবৎ’। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি বক্তব্য নিতেই হচ্ছে,

‘এখানে ১৯৬৭ সালের একটা ঘটনা বলি। ১৯৬৭ সালের গোড়ায় ৬ দফা কর্মসূচি প্রচারের জন্য শেখ মুজিব বাংলাদেশে ঝটিকা সফরে ব্যস্ত। মোনেম খানের পুলিশ পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৭ই এপ্রিল খুলনায় বিরাট জনসভা। আমিও গিয়ে হাজির হলাম ঢাকা থেকে খুলনায়। শেখ মুজিবের সভায় জনসমুদ্রের ঢল দেখে বিস্মিত হলাম। সন্ধ্যায় খুলনা থেকে যশোরে ফিরলেন শেখ মুজিব। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। খুলনার শিরিন হোটেলে বসে খবরটা শুনেই শেখ মুজিবের উপর একটা কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা বোধ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে লিখেও ফেললাম।

‘সিংহকে শিকলে বাঁধে শৃগালের দল’।… কবিতাটা নিজের কাছে ভালো লেগেছিল। তাই ভাবলাম, ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ ছাপাতে দেব। ইত্তেফাক তখন ৬ দফা সমর্থন করতে শুরু করেছে। ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়া তখন জীবিত এবং তার বড় ছেলে মইনুল হোসেন বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছে। শেখ মুজিবকে সে কাকা ডাকে। তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তার চাইতেও বেশি।

কিন্তু কবিতাটি ইত্তেফাকে ছাপা হলো না। মইনুল আপত্তি জানালো। আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললে : শেখ মুজিবকে অত বড় করে দেখিয়ে কবিতা লিখেছেন কেন?’ (ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগষ্ট পঁচাত্তর, পৃ: ৯৩)।

এরপর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের চৌকস মধ্যবিত্তরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো ধারণা পোষণ করে না। এ দেশের নুন আনতে পান্তা ফুরানো, লুঙ্গি পরা মানুষ মার্কসবাদের কী জানে? এ দেশের চৌকস মধ্যবিত্ত, অভিজাত পণ্ডিতরা মার্কসবাদ চর্চা করে। তারা শেখ মুজিবকে অত পছন্দ করে না, তারা বরং জিন্নাহকে পছন্দ করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকেও মান্য করে। এজন্যই বিএনপি জামায়েতের প্লাটফর্ম থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে সব কদর্য মিথ্যাচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করেনি ওই তাত্তি¡করা, তারা এমন মিথ্যা কথাও বলেছেন, ‘১৫ আগস্টই প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস।’ ১৯৭০ সালে এক মহাতাত্তি¡ক বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের কাজ না দেশ স্বাধীন করা।’ তিনি আবার ড. কামাল হোসেনের বাসায় যাতায়াত করতেন। ‘অভিজাত’ বলে কথা। আজকাল তো কলমের জোর আর টাকার জোর প্রায় সমান সমান।

১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনী ২ লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল, এরা পক্ষেও জামায়াতি ক্রিমিনালরা হাদিস খাড়া করেছে। পাশাপাশি চীন যে পাকহানাদার বাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিল তার পক্ষেও ঈর্ষায় অন্ধ মহাতাত্তি¡করা মার্কসবাদী ফতোয়া খাড়া করেছিলেন। তাদের সা¤প্রদায়িক দাঁতও দেখেছি আমরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা বলতেন, ‘ভারত-রাশিয়ার স¤প্রসারণ বাদ’। এরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা মণিসিংহকে যেভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন তা গভীর মর্মবেদনার সঙ্গে মনে পড়ে।

অতি স¤প্রতি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। বলেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু অসাংবিধানিক ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেননি।’

অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদ। এই তিনজনই ক্ষমতার শীর্ষে বসে ধর্মের রাজনীতি করেছেন। আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে হলে কথায় কথায় মিথ্যার ফানুস উড়াতে হয়। জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে মানুষ মাথায় টুপি দিতে পারত না।’ সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি, রাস্তায় মিলাদ পড়তে হয়েছে- সেই বাড়ি আমাকে হস্তান্তর করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। আইনজীবীর মাধ্যমে বাড়ি বুঝে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। তখন বুঝতে পারিনি তাদের এত তাড়া কেন? বাড়ি হস্তান্তর করার পরে ৪০ দিন ধরে টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে ওই বাড়িতে হীরা, মুক্তা, টাকা পাওয়া গেছে। আর জিয়া একটি ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গেছে।’ (আমার সংবাদ ০২/০৮/২০১৬ইং)।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালকে নিয়ে, তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিকে নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচার চালানো হয়েছিল। ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যাচার এক সঙ্গে চলেছিল। জেনারেল এরশাদ তো মসজিদে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলতেন। তখনকার আলেম সমাজ মসজিদকে মিথ্যা দিয়ে অপবিত্র করার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। বরাবর আলেম সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ফলাফল এমনই হয়ে থাকে। আলেমরা সম্রাট আকবরের পক্ষেও ছিলেন বিপক্ষেও ছিলেন, ইংরেজের পক্ষেও ছিলেন বিপক্ষেও ছিলেন, আইয়ুব খানের পক্ষেও ছিলেন বিপক্ষেও ছিলেন, জিয়া-এরশাদের পক্ষেও ছিলেন বিপক্ষেও ছিলেন।

১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শুনেছি অত্যন্ত নিম্নমানের মিথ্যা কথা। নির্বাচনী মাঠে বলা হয়েছিল ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এ দেশ হিন্দুদের দেশ হয়ে যাবে। যদি আপনাদের সন্তানের নাম রাম না রেখে রহিম রাখতে চান তাহলে ধানের শীষে ভোট দিন।’

তবে জামায়াতের মিথ্যাচারের নৈপুণ্যতা বেশি। খালেদা জিয়ার মন্ত্রী নিজামী বলেছিলেন, ‘বাংলাভাই বলে কেউ নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ তারপর বাংলাভাইদের ফাঁসি হয়েছে। এই মিথ্যায় খালেদা জিয়াও সায় দিয়েছিলেন। সাঈদীর নির্বাচনে বলা হয়েছিল তাকে ভোট দিলে বেহেস্ত পাওয়া যাবে। সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক করার পর এই ধর্মব্যবসায়ীকে আকাশে তুলে মিথ্যা, বানোয়াট ছবি দেখানো হয়েছে তার ফাঁসি রদ করার জন্য। এই মিথ্যাচারের সঙ্গে খালেদা জিয়া এবং খালেদাপন্থী বামেরাও জড়িত। ১৯৫৩ সালে মোল্লা মওদুদীও মিথ্যা প্রচার চালিয়ে পাকিস্তানে শত শত কাদিয়ানি হত্যা করেছিল। তারও ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্র সৌদি আরবের সুপারিশে মওদুদীর ফাঁসি রদ হয়।

অতি স¤প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফজরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতারাই জড়িত। জামায়াত ইসলামী বলে আসছে, আওয়ামী লীগই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। বিএনপির প্লাটফর্ম থেকে বলা হয়েছিল, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগ করেছিল। মিথ্যা ইতিহাস খাড়া করার জন্য কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতার দলিলপত্র পরিবর্তন করা হয়েছিল।

পৃথিবীর সব ধর্মে লেখা আছে ‘মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে, আর সত্যই মানুষকে রক্ষা করে।’ মিথ্যুকরা আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।

মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক।

SUMMARY

2069-1.gif