মাহমুদুল বাসার
লন্ডন থেকে জিয়াপুত্র তারেক জিয়া বিশ্বমিডিয়ার সামনে বললেন, বঙ্গবন্ধু নাকি সংসদ কক্ষ্যে তখনকার ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। আমাদের একজন মহান পূর্ব পুরুষ, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এ ঘটনা নাকি সে বইতে লেখা আছে। তারেক জিয়া নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছেন। আবুল মনসুর আহমদ বঙ্গবন্ধুর একরোখা দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে দোষারোপ করলেও শাহেদ আলীকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন, এ ধরনের কোন কথা বলেন নি।
আবুল মনসুর আহমদের বইটি বাংলাদেশে জাতীয় দলিল হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। সম্প্রতি এ বইটি আমি কিনেছি। এর অনেক আগে আমি বইটি পড়েছি, আমার লেখা ‘স্বাধীনতার স্থপতি’ বইটিতে অনেক উদ্বৃতি নিয়েছি। যা হোক, ঢাকার খোজরোজ কিতাব মহল বইটি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ পুনর্মুদ্রন করেছে। সেই মুদ্রিত বই থেকে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ যা বলেছেন তা তুলে দিচ্ছিঃ “স্পিকার আবদুল হাকিম সাহেবের প্রতি আমাদের পার্টি- নেতাদের আস্থা ছিলনা। তার উপর একটা অনাস্থা প্রস্তাব ও দেওয়া হইয়াছিল। সে প্রস্তাব বিবেচনার সুবিধার জন্য নিজে হইতে ডিপুটি স্পিকারের উপর ভার দিয়া সরিয়া বসা তার উচিত ছিল। তিনি তা না করিয়া নিজেই সে প্রস্তাব বাতিল করিয়া দিলেন। এই ভাবে স্পিকারের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত লাগায় মুজিবুর রহমান আমাকে বলিলেন ঃ ডিপুটি স্পিকারকে শক্ত করিয়া আমাদের পক্ষ করিতে হইবে।………….কিন্তু স্পিকার ছিলেন তখন বিদেশে। এখন স্পিকার দেশে হাযির। তার সাথে আমাদের পার্টির সংঘাত। এই অবস্থায়ই তাকে (শাহেদ আলীকে) বুঝাইয়া একটু মযবুত করিয়া দিতে মুজিবুর রহমান আমাকে ধরিলেন। আমি ডিপুটি স্পিকারের বাড়ি গেলাম। অনেক কথা হইল। তিনি মযবুত হইলেন।
ডিপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরুল হইল। হাউস শুরু হইল মানে অপযিশন দলের হট্টগোল শুরু হইল। শুধু মৌখিক নয়, কায়িক। শুধু খালি-হাতে কায়িক নয়, সশস্ত্র কায়িক। পেপার ওয়েট, মাইকের মাথা, মাইকের ডান্ডা, চেয়ারের পায়া-হাতল ডিপুটি স্পিকারের দিকে মারা হইতে লাগিল। ………….বুঝিলাম, ওদেরও মনে আমারই মত রাগ ছিল সে রাগের কারণ ডিপুটি স্পিকার অন্যায় ভাবে সরকার পক্ষকে সমর্থন করিতে ছিলেন। ডিপুটি স্পিকারকে হত্যা করিবার ইচ্ছা অপযিশন মেম্বারদের কারও ছিল না নিশ্চয়ই। এমন কি, অমন অসভ্য গুন্ডমীতে যারা অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাদের সকলে জানিয়া বুঝিয়া ইচ্ছা করিয়া এই আক্রমণ করেন নাই। আমি নিরপেক্ষ দর্শকের দৃষ্টি দিয়াই দেখিয়াছি, হামলাকারীদের অনেকেই স্পন্টেনিয়াসলি, নিজের অজ্ঞাতসারেট, তখন শুধু দেখাদেখি পাটকেল নিক্ষেপ করিতেছেন।………..দেহরক্ষীরা চেয়ারের পাহাড় না তুলিলে তিনি ঐ মঞ্চের উপরই মরিয়া একদম চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেন। পরের দিন হাসপাতালে তিনি সত্য সত্যই মারা যান। ঐ ঘটনার পনর দিনের মধ্যেই মার্শাল-ল। শাহেদ আলীর অপমৃত্যুকে মার্শাল ল প্রবর্তনের অন্যতম কারণ বলা হইল অর্থাৎ পরের ঘটনার জন্যই আগেরটা ঘটিয়াছিল বা ঘটান হইয়াছিল। আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করিতে গিয়া শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপযিশনের ঢিল- পাটকেলে। অথচ পূর্ববাংলার দুশমনরা তখনও বলিলেন এবং আজও বলেন ঃ আওয়ামীলীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে। কোন পাপে এ মিথ্যা তহমত।” (পৃ: ৪৩৪, ৩৬, ৩৭)।
আবুল মনসুর আহমদ উকিল ছিলেন, এ জন্য কথা গুলো খোলাসা করে বলেননি। ১৯৫৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শাহেদ আলী মৃত্যুবরণ করেন। ঐ সময়ে প্রাদেশিক সরকারে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, আর বিরোধীদল অর্থাৎ আবুল মনসুর আহমদ কথিত ‘অপযিশনে’ ছিলো শেরেবাংলার নেতৃত্বাধীন কে, এস, পি। কে, এস, পি-র মারমুখো সদস্যরাই ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করেছেন। পঞ্চাশের দশাকের স্বনামধন্য- সাংবাদিক, লেখক, গবেষক প্রয়াত আবদুল মতিন হট্টগোলের সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক হিসেবে। তিনি তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন ঃ
“১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। ………পূর্ব পাকিস্তানে তখন আওয়ামীলীগ দলীয় নেতা আতাউর রহমান খান প্রধানমন্ত্রী। ফজলুল হকের আমলে কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থনে নির্বাচিত স্পীকার আবদুল হাকিম তার কার্যকলাপে প্রমাণ করেন, তিনি ঘোরতরভাবে আওয়ামীলীগ বিরোধী।
২০ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য হাসেম উদ্দিন আহম্মদ কোয়ালিশন দলের ৬ জন সদস্যের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এদের পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের কোন অধিকার নেই। কারণ নিবাচনী কমিশন এদের নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে কমিশনের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেয়। ইচ্ছাকৃত ভাবে হাসেম উদ্দিন সাহেব একথা উল্লেখ করেন নি। তার বক্তব্য সম্পর্কে স্পীকার বলেন, ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি এ সম্পর্কে ‘রুলিং’ দেবেন। এর ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা মূলক পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী স্পীকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। স্পীকার এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ফলে পরিষদ কক্ষে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হয়ে স্পীকার পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
এরপর ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী স্পীকারের আসন দখল করেন। দেওয়ান মাহবুব আলী তার প্রস্তাব পুনরায় পেশ করেন। প্রস্তাবটি সম্পর্কে ভোট গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১৭০ জন ভোট দেওয়ায় স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হয়।
………….২৩শে সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী পরিষদ কক্ষে প্রবেশ করে স্পীকারের আসন গ্রহণ করলে সরকার পক্ষ তাকে সমর্থন জানান। বিরোধী পক্ষ প্রবল প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড বাদানুবাদ হয়। বিরোধীদল শাহেদ আলীকে আসন ত্যাগ করার দাবি জানায়। এক পর্যায়ে পরিষদ কক্ষে ব্যাপক হাঙ্গামা শুরু হয় এবং সদস্যরা একে অপরকে শারীরিক আক্রমণ করেন। কেউ কেউ ডেপুটি স্পীকারকে লক্ষ্য করে হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা ছুড়তে শুরু করেন।………….আমার সামনে প্রেস গ্যালারীর অনুচচ দেওয়ালের তিন-চার সারি দূরের একটি আসনে কৃষক প্রজা পার্টির প্রভাবশালী সদস্য ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) বসে ছিলেন। তার চোখে মুখে উত্তেজনার চিহ্ন স্পষ্ট । টেবিল হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সদস্যদের আসনের উভয় হাতলের উপর রাখা এক টুকরো পালিশ করা চ্যাপ্টা কাঠের এক মাথায় স্ক্র দিয়ে লাগান ছিল। মোহন মিয়া তার আসনের সঙ্গে লাগান কাঠের টুকরোটি খুলে নিয়ে হঠাৎ শাহেদ আলীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন। কাঠের টুকরোটি তার মুখে ও বুকে গিয়ে লাগলো। তিনি গুরুতর আহত হয়ে তার আসনের উপর লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাকে নিকটস্থ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৬শে সেপ্টেম্বর তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।”
(স্মৃতিচারনঃ পাঁচ অধ্যায়, রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিশাস- ঢাকা- ১৯৯৪, পৃ: ১৭, ১৮, ১৯)।
কে, এস, পি-র নেতৃবৃন্দ যে কোন উপায়েই হোক আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটাবার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার সঙ্গে আঁতাত করে প্রাদেশিক পরিষদে উল্লেখিত জঘন্য হট্টগোলের সৃষ্টি করেছিলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যে ভাবেই হোক সংসদ অধিবেশন বানচাল করা যাতে সামরিক শাসন জারি হয়। আবদুল মতিন বলেন, “৭ই অক্টোবরের মধ্যে রাত্রে কৃষক প্রজা পার্টি ও আওয়ামীলীগ বিরোধী মহলের আশা পূর্ণ হলো। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার আসনবণ্টন নিয়ে ফিরোজ খান নুনের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতবিরোধের ফলে আওয়ামীলী মন্ত্রীরা ২রা অক্টোবর কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সঙ্কট এবং শাহেদ আলী হত্যাকান্ডের ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা জেনারেল আইয়ুব খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন।” (ঐ পৃ: ১৯)।
এতটা সুনির্দিষ্ট করে আবুল মনসুর আহমদ বলেননি যা বলেছেন আবদুল মতিন। তবে এটুকু বলেছেন বঙ্গবন্ধু শাহেদ আলীকে সমর্থন করেছিলেন।
তারেক জিয়া ইতিহাসের অপচর্চা করার ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার পরই পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনা প্রধান এ, কে খন্দকার। তিনি তার বইতে বললেন, ৭ মার্চের মহা ভাষণে বঙ্গবন্ধু নাকি ‘জয় পাকিস্তান’ বলে বক্তৃতা শেষ করেছেন। তিনি নাকি যুদ্ধের দিক নির্দেশনাই দেন নি। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর কোনো ম্যাসেজ ই দেননি; অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।
এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিএনপি পন্থী বাম লেখকরা এসব কথা বরাবরই বলে আসছেন। এ,কে, খন্দকার নতুন কিছু বলেননি। ৭ মার্চের মহাভাষণ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদের কথাই আগে তুলে ধরবো। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের ৫৫৫ -৫৬ পৃষ্ঠায় (খোশরোজ কিতাব পুন মুর্দ্রন-২০১৩) বলেছেন, “ অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্বশালী শেখ মুজিব তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই সত্য, তবে তরুণদের চাপে অন্ততঃ তাদের মন রাখিলেন। শুধু তাদের দেখাইবার উদ্দেশ্যেই পরিষদে যোগ না দিবার ব্যাপারটার ঐরূপ ধীরত্বব্যঞ্জক ব্যাভাডো প্রদর্শন করিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিদার তরুণদের খুশি করিবার জন্য শেখ মুজিব আরো দুইটা কাজ করিলেন। প্রথমতঃ উপসংহারে তিনি বলিলেনঃ আজিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। দ্বিতীয়তঃ কিছুদিন ধরিয়া তিনি সব বক্তৃতা শেষ করিতেন এক সংগে ‘জয় বাংলা’ জয় পাকিস্তান’ বলিয়া। এই দিনকার সভায় প্রথম ব্যতিক্রম করিলেন। শুধু ‘জয় বাংলা’ বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেন। যারা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন, তাদের কেউ- কেউ আমার এই কথার প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, শেখ মুজিব ৭ই মার্চের সভাতে ‘জয় বাংলা’ জয় পাকিস্তান’ বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে পরদিন আমি রেডিও টেলিভিশনে নিজ কানে তার বক্তৃতা শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না, তার জবাবে তারা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল। যাক আমি নিজ কানে যা শুনিয়াছিলাম, তাই লিখিতেছি।”
আবুল মনসুর মনসুর আহমদ তার স্মৃতিচারনায় নিñিদ্র সততা রক্ষা করেছেন। এ, কে, খন্দকার নূন্যতম সততা রক্ষা করেননি। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ সকালে রেডিও থেকে প্রচারিত সাতকোটি বাঙালি আবুল মনসুর আহমদের মত ‘জয়বাংলা’ই শুনেছিলো ‘জয় পাকিস্তান শোনে নাই। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জয় বাংলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো।
একটি বক্তৃতায় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাই ঘোষণা করেছিলেন তবে কৌশলে শব্দ চয়ন করে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিশিষ্ট কলাম লেখক প্রয়াত বজলুর রহমান বলেছেন, ‘তবু তরুণ প্রজন্মের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ছিল লক্ষনীয়।’ (সাপ্তাহিক একতা-১৯৮৮)। চিন্তাশীল লেখক আহমদ ছফা বলেছেন, ‘উনিশশ পঞ্চান্ন কি ছাপ্পান্ন সালে পিকিংএ পশ্চিম বাংলার কথা সাহিত্যিক শ্রী মনোজ বসু একটা সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগদান করেছিলেন। সেখানে বাংলার তরুণ রাজনীতিবিদ জনাব মুজিবুর রহমানও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। শ্রী- বসুর সঙ্গে এক উদ্বেল মুহূর্তে বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্র গড়ার অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন।’ (জাগ্রত বাংলাশে, মুক্তধারা – ১৯৭১, পৃ: ২৭)।
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে মগবাজারে আওয়ামীলীগের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গোপনে যে ৪টি বৈঠক হয় সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই।’ (আবদুল মতিন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঃ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়- উদ্দেশ্যমূলক প্রচারনা)। সাংবাদিক লেখক আবদুল মতিন জানিয়েছেন, ১৯৬২ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহুর লাল নেহেরুর কাছে রাষ্ট্রদূত শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জীর মাধ্যমে অস্ত্র সহযোগিতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য। নেহেরুজী এ প্রস্তাবে রক্ষা করতে পারেননি। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘একজন মানুষ কতটা মরিয়া হলে এমন প্রস্তাব করতে পারে।’ আগর তলা ষড়যন্ত্র মামলার নামই ছিলো ‘স্টেট বনাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ লেঃ কঃ মোয়াজেম হোসেনর নেতৃত্বে যে সব সৈনিক সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন তারা প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহ্ রাওয়ার্দীর জন্মদিনের জন সভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে বাসায় খেতে বসে বঙ্গবন্ধু ড. ওয়াজেদকে বলে ছিলেন, ‘এদেশটা স্বাধীন হলে কবি গুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ হবে জাতীয় সঙ্গীত।’ ৬ দফা পেশ করার পর প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখানেই কি শেষ?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য সাঁকো দিলাম।’ ৬ দফার ৩নং দফায় বঙ্গবন্ধু দাবি করেছিলেন, ‘সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।’ এখানেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বীজ রোপন করেছিলেন। এ জন্য আইয়ুব খান ৬ ফাকে অস্ত্রের ভাষায় মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতার স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন। ২৩ মার্চ সংগ্রামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার ধানমন্ডির বাসভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২৩ মার্চে সারা বাংলাদেশে এক মাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পাকিস্তানের পতাকার অস্তিত্ব ছিলো না। ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছিলেন। ৩৫টি নির্দেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় তার গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা লাগিয়ে রাখতেন; ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় যেতেন গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে।
মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেছেন সংসদে, ‘২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামে মাইকিং করা হয়েছিলো যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ইপিআর ওয়্যার লেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে স্বাধীনাত ঘোষণার বার্তা প্রেরণ করেছিলেন বলেই সেটা অবলম্বন করে মাইকিং হয়েছিলো। চট্টগ্রাম বেতার থেকে যে যা কিছুই ঘোষণা করেছেন তা বঙ্গবন্ধুর নামেই করেছেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু আগেই একটি গোপন বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণার কণ্ঠ দিয়ে রেখেছিলেন। সেটি ২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর ইপি আরের এক জোয়ান ঢাকা বলাদাগার্ডেনে দাঁড়িয়ে বাজিয়েছিলেন তার পর জোয়ানটি রেডিও পুকুরের মাধ্য ফেলে দেয়। ঐ কণ্ঠস্বর মেজর সিদ্দিক সালিকের রেডিওতে বেজে ওঠে। সেই মোতাবেক বঙ্গবন্ধুকে পাক মিলিটারিরা গ্রেফতার করতে আসে। ২৬ মার্চ রাতে বেতারে একজন্যই ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘শেখ মুজিব ইজ এ ট্রেইটর, হি উইল নট গো আনপানিশড।’
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছেন। আর এ, কে, খন্দকার কিনা মন্ত্রীত্ব হারিয়ে বলছেন, বঙ্গবন্ধু কোন নিদেশই দেননি।
প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক