জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার

 
এডভোকেট ওমর হাসান আল জাহিদ :
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার || এডভোকেট ওমর হাসান আল জাহিদসম্পাদনায়,খোরশেদ আলম,বাংলাদেশ প্রেস || অবশেষে পড়ে শেষ করলাম, আনোয়ার উল আলম-এর লেখা ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বইটি। চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই। অনেক অজানা কাহিনী উন্মোচন করেছেন বইটির লেখক, যিনি জাতীয় রক্ষীবাহিনীর একজন প্রতিষ্ঠাতা উপ-পরিচালক ছিলেন। লেখকের আরেকটি পরিচয় হল তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র বেসামরিক প্রধান ছিলাম।

বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের সবচেয়ে সমালোচিত একটি অধ্যায় হল, জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন ও এর কার্যক্রম। আজ পর্যন্ত আমি কোথাও রক্ষীবাহিনীর সমালোচনা ছাড়া প্রশংসা শুনিনি। তাই যখনি প্রথম আলো’তে বইটি সম্পর্কে জানতে পারি, তখনি বইটি পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। বইটি পড়ে মনে হল রক্ষীবাহিনীর যেসব সমালোচনা করা হয়, সেসব বেশির ভাগই একদম অযৌক্তিক, বানোয়াট, গুজব এবং অর্ধসত্য। অবশ্যই রক্ষীবাহিনীর বেশ কিছু প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম রয়েছে। তবে মহলবিশেষের পরিকল্পিত নানা গুজবই রক্ষীবাহিনীকে বিতর্কিত করে তোলে। আর এসব গুজব সশস্ত্র বাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর একটি প্রকাশ্য মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকট করে তোলে। অথচ রক্ষীবাহিনীর বিভিন্ন কার্যক্রম ছিল প্রশংসাযোগ্য; বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন দেশে অস্ত্রউদ্ধার, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্ক্ষলার অবনতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী দারুণ ভূমিকা পালন করে।


রক্ষীবাহিনী নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য সমালোচনার ব্যবচ্ছেদ করা যাক। তৎকালীন সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে দুটো গুজব ‘সত্য’ হিশেবে ছড়িয়ে পড়ে। একটি হল, রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এদের অধিকাংশ ভারতীয়। অন্যটি হল, রক্ষীবাহিনীর বাজেট সশস্ত্র বাহিনীর বাজেটের চেয়ে বেশি। দুটি তথ্যই সশস্ত্র বাহিনীর ভিতরে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং সরকারের উপর মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে। অথচ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেখা গেল রক্ষীবাহিনীর সর্বমোট সদস্য মাত্র বারো হাজার এবং ভারতীয় কোনো সদস্য পাওয়া গেল না। তবে রক্ষীবাহিনীর উপর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ হত ভারতে; তৎকালীন সময়ে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তাছাড়া শুধু রক্ষীবাহিনী নয়, সশস্ত্র বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাও ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। আর বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা গেল, ১৯৭৩ সালে রক্ষীবাহিনীর জন্য বাজেট ছিল মাত্র ৯ কোটি যেখানে সেনাবাহিনীর জন্য বাজেট ছিল ৯২ কোটি, যা পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১২২ কোটি করা হয়।

বিখ্যাত/কুখ্যাত ‘আদর্শবাদী-সন্ত্রাসী’ সিরাজ শিকদারকে গ্রেফতার থেকে হত্যা পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অথচ জনমানসে এমনটাই প্রতিষ্ঠিত যে, সিরাজ শিকদারকে রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছে। রক্ষীবাহিনীর পোশাকের জলপাই রং নিয়েও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন তোলা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খাকি পোশাক ব্যবহার করত। তাই রক্ষীবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের ওই পোশাকের প্রতি ঘৃণা কাজ করে। তাই তারা বেছে নেয় ভারত থেকে আনীত জলপাই রং-এর পোশাক। অবশ্য ভারত থেকে খাকি ও জলপাই রং- দুই ধরনের পোশাকই আনা হয়েছিল। কিন্তু বামপন্তীরা গুজব ছড়ায় যে, জলপাই রং-এর পোশাক নেয়ার কারণ হল ভারতীয় সৈন্যরা যাতে একই পোশাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে; যেহেতু ভারতের সেনাবাহিনীরও একই রং-এর পোশাক ছিল। অথচ তখন বাংলাদেশ-ভারতের নৌবাহিনীর পোশাক একই রং অর্থাৎ শাদা ছিল; কিন্তু এটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি কিংবা কারো মনে হয়নি যে, ভারতীয় সৈন্যরা একই পোশাক পরে নৌপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় উপহাস হল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরবর্তী সময়ে জলপাই রংয়ের পোশাকই বেছে নেয়। অথচ এটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি কখনো।

এরকম আরো অনেকগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব/মিথ্যা ছড়ানো হয় রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে। অবাধ তথ্যের অভাবে সাধারণ মানুষও সেসব বিশ্বাস করতে শুরু করে। ক্রমেই মানুষের কাছে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে রক্ষীবাহিনী।

SUMMARY

2065-1.png