বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও মানবতাবোধ

আলী রেজা

ব্রিটিশ ভারতে প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিপ্লবের মাধ্যমে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আইন পাস হলে মুসলমানগণ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে আর হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অখ- ভারত ও হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতে থাকলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে গঠন করে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ (১৯০৬ খ্রি.)। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যৌথ আন্দোলন চালাতে থাকে। এদিকে ব্রিটিশ সরকার সময় সময় ভারত শাসন আইন করে ভারতীয় জনগণের কিছু কিছু রাজনৈতিক অধিকার দিতে থাকে। ভারতীয় কাউন্সিল আইন (১৮৬১ খ্রি.), ভারতীয় কাউন্সিল আইন (১৮৯২ খ্রি.), মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন (১৯০৯ খ্রি.), ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু- চেমসফোর্ড আইন (১৯১৯ খ্রি.)-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতীয় জনগণকে ক্রমশ কিছু কিছু রাজনৈতিক অধিকার দিতে থাকে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিপক্ষে ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়।। ফলে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হলো তখন মুসলিম সম্প্রদায় আশাহত হলেন এবং হিন্দু সম্প্রদায় উল্লাসিত হলেন। এভাবে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব বেড়ে যায় এবং পরবর্তীতে তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা খর্ব করলে ভারতীয় মুসলমানগণ ক্ষুব্ধ হয় এবং খেলাফত আন্দোলনের ডাক দেয়। এদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-১৯২২ খ্রি.) হাওয়া বইতে থাকে ভারত জুড়ে।

ব্রিটিশ ভারতের এই সংগ্রামমুখর উত্তাল সময়ে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহুকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতি করলেও পরবর্তীতে মুসলিম লীগ সরকার জনকল্যাণমূলক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ না করার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন এবং পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ গঠন করেন। এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে আবর্তিত হতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হাজার বছরের গৌরবময় অর্জন স্বাধীনতা লাভ করে।

বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কারণ হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি যে পরাধীনতার গ্লানি ভোগ করে আসছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতি সেই পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। বর্তমান নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও মানবতাবোধ বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে আমরা লক্ষ্য করি রাজনৈতিক শিষ্টাচারের চরম পরাকাষ্ঠা। পাকিস্তান সরকারের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামে ছিল যথার্থ সুবিবেচনা ও সংযম। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু একটি মুক্তিকামী জাতিকে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন সে দিক নির্দেশনায় ছিল একটি জাতিকে সুসংগঠিত করার মন্ত্রশক্তি। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের মূলমন্ত্র ছিল ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’। এ নীতির ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি বলতেন, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে শোষক, অন্য পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে প্রায় ১৩ বছর ৯ মাস জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা ছিল মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই আমরা দেখি যে কোন মানবিক বিপর্যয়ে বঙ্গবন্ধু ছুটে চলেছেন পূর্ববাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানের অখ-তাও সমর্থন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ এতটাই অমানবিক হয়ে উঠেছিল যে অখ- পাকিস্তানে মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা আর জীবনযাপন করতে পারছিল না। অগণিত বাঙালি শোষিত হচ্ছিল দিনের পর দিন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রতাপশালী পাকিস্তান সরকারের প্রতি তর্জনী নির্দেশ করে বলেছিলেন ‘আর যদি একটা গুলি চলে...’। বঙ্গবন্ধুর এই চ্যালেঞ্জ ছিল নিরীহ বাঙালির উপর পশ্চিম পাকিস্তানের জুলুম-নির্যাতন মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ। চরম বৈরী সম্পর্কের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে চলেছেন। প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রতিপক্ষের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন তিনি। চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনীতি করেও বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ ছিলেন।

পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রিত্ব পাননি। বাঙালি জাতি তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নিরীহ বাঙালি জাতির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। তবুও বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জন করেননি। টেলিফোনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বলেছেন, ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপর, আমার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন’ (৭ মার্চের ভাষণ)। বঙ্গবন্ধুর এই আকুতি কোন রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয় নয়, এটা মানুষের প্রতি মানুষের গভীর মমত্ববোধ থেকে উৎসারিত। এই মমত্ববোধ বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল মানবকল্যাণকেন্দ্রিক। তিনি কোন ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেন না। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি; স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেও তিনি গরিব-দুঃখী ও মেহনতি মানুষের কথা মনে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুরগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’- তখন বঙ্গবন্ধুর মানবতাবোধের কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ না করে পারি না।

দোর্দ- প্রতাপশালী পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েও বঙ্গবন্ধু প্রতিপদে ভেবেছেন বাঙালির সুখ-দুঃখের কথা। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালি নয়, পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের কথাও ভেবেছেন। তাদের স্বার্থে কাজ করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল মানবতাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রেখেছেন। তিনি বলতেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে তবে সে সংখ্যায় একজন হলেও আমরা তা মেনে নেব’। এই রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম করতে গিয়েও বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেছেন। সকল জাতি-ধর্মের প্রতি ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই’। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, দেশপ্রেম, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ এবং সর্বোপরি শোষণ-নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম তাকে একজন রাজনীতিবিদ থেকে মানবতাবাদী দার্শনিকে পরিণত করেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন যেমন রাজনৈতিক শিষ্টাচারে সমৃদ্ধ তেমনি মানবতাবোধে ঋদ্ধ।

[লেখক : কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক]

SUMMARY

2062-1.gif