ড. আতিউর রহমান
বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতার বিকল্প কোনো শব্দ নেই। মানুষ দরিদ্র হতে পারে কিন্তু স্বাধীন মানুষের আত্ম-মর্যাদাবোধ সবচেয়ে বড় সত্য, চিরভাস্বর। বাঙালি জাতির ভাগ্যে সেই চিরন্তন শব্দটির রূপদান করেছেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। যাঁর তুলনা শুধুই তিনিই।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্থান ছিল যেমন দাপটের তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম দেখে মুগ্ধ হন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বিপুল স্নেহধন্যে সিক্ত হতেন মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ই প্রমাণ করে কি বিপুলভাবে তিনি তাঁদের সমর্থন পেয়েছিলেন।মাটি থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটে তাঁরই পরিচালনায় বায়ান্ন-একাত্তর পর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধে। পুরো ষাটের দশক ছিল এই জাতীয়তাবাদের বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে বের হয়ে আসা তরুণ নেতৃত্বকে আরও সুসংহত করে। ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে গগণবিদারী এক গণআন্দোলনের মাধ্যমে বন্দি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তিত করে এই সংগ্রামী নেতৃত্ব। এই তরুণ নেতৃত্ব পুরোনো বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সারা পূর্ব-বাংলায় যে সফল গণজোয়ার তৈরি করে তাঁর পুরো নিয়ন্ত্রক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের সামরিক-অসামরিক আমলা, রাজনৈতিক স্বার্থাম্বেষী মহল বাঙালি নেতৃত্বের এই উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে সাধারণ নির্বাচনে বিশাল ম্যান্ডেট পাওয়া গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ নেতৃত্বকে ডাক দিতে হলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। ২৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নিয়ন্ত্রক। তাঁর নামেই চলেছে মুক্তিযুদ্ধ। তিনিই ছিলেন বাঙালির শৌর্য ও ঐক্যের উৎস।
সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তবে কথা বলতেন সাধারণের ভাষায়। সাধারণের দুঃখ-কষ্ট তাঁকে সর্বদাই মর্মাহত করত। আজীবন তাই ছুটে বেড়িয়েছেন স্বদেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত। স্বদেশের মুক্তির সব খন্ডখন্ড উদ্যোগের সূত্র ধরে একটি মহাজাগরণের সূচনা করতে পেরেছেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুই। তিনি কারও কারও ঈর্ষার পাত্র, শত্রু ভাবাপন্ন হলেও কারও কাছে ছিলেন স্বপ্নের সম্রাট; আর সাধারণের হৃদয় জুড়ে ছিল যাঁর অধিবাস। বঙ্গবন্ধু বলতেন “আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে”।
বাঙালি জাতির স্বাধিকার অর্জন ও মুক্তি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর বর্ণিল জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সমগ্র বাঙালি জাতির ভালবাসা ও তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি জান্তাদের গভীর ষড়যন্ত্রে ফাঁসির কাঠগড়া থেকে বারবার ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। অকুতোভয় জাতীয় বীরের শিরোপাধারী বঙ্গবন্ধু জীবনের সোনালী দিনগুলি অকাতরে উৎসর্গ করেছেন এদেশের মাটি আর মানুষের জন্যে। ১৯৭২ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে আটক। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিলে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর বীরোচিত প্রত্যাবর্তন ঘটে। এক মুহূর্তকাল সময় অপচয় না করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন (১২ জানুয়ারি ১৯৭২) বঙ্গবন্ধু। শুরু হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে নতুন করে নির্মাণের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নিরলস পথচলা।
ভারতের আহ্বানে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেন। একই মাসের ২৮ তারিখে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। গরিব হিতৈষী বঙ্গবন্ধু ১ মে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করা হয় এবং অস্ত্রোপচারের পর লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। অত:পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর রাশি রাশি পদক্ষেপের পাহাড় জমা হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল সম্মোহিত করার মতো। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরাজিত শত্রু পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতিদানে বঙ্গবন্ধুর যে একটি রাজনৈতিক মুন্সীয়ানা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। এবছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। ১০ অক্টোবর ১৯৭২ ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে বিশ্বশান্তি পরিষদ এক ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২৩ মে ১৯৭৩ বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পদক প্রদান করেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশ চন্দ্র।
বঙ্গবন্ধু জানতেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশ্ব জনমত গঠন একটি মোক্ষম অস্ত্র। তাই তিনি দেশের অবহেলিত মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে মনের অন্তর্গভীরে পররাষ্ট্রনীতির প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ হতে থাকেন। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় সমৃদ্ধ। বঙ্গবন্ধু সরকার তাই বিশ্বজুড়ে স্বীয় পরিচয়, আধিপত্য বিস্তার ও অন্তহীন সহযোগিতার লক্ষ্যে “সবার সঙ্গে মৈত্রী, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়” এমন নীতি গ্রহণ করেন। প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের সামঞ্জস্য থাকলেও নতুন দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও মুক্তির লক্ষ্যে পররাষ্ট্রনীতি, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমামুখী করার নীতি গ্রহণ করা হয়। এমন কি বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার প্রতি বৈরী চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ভারত-বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শক্তিশালী ভিত গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও অবদানের জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর সরকার ও জনগণের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান। এই সময় বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া ও অন্যান্য পূর্ব-ইউরোপীয় দেশ, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ, বিশ্ব-নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু চীনের প্রসঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের মতো উপনিবেশিক শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই চীন স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাই অচিরেই তারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বীরোচিত সাফল্যকে স্বীকৃতি দেবে। বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের শতাধিক (১২১টি) দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাকিস্তানে আটক বাঙালি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনা, জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক অনেকগুলো সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি। রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির অনন্য প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে এদেশ থেকে প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হন যা ছিল বঙ্গবন্ধুর আকাশ ছোঁয়া সাফল্য। স্বাধীন জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। পাশাপাশি ইসলামী বিশ্ব আর পশ্চিমা শক্তির সাথেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এ কারণেই ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ আর পাকিস্তানের শর্তহীন স্বীকৃতি আসে ১৯৭৪ সালে। তখন চীন এবং সৌদী আরবের স্বীকৃতি প্রাপ্তি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র (বাংলাদেশকে ৮ অক্টোবর, ১৯৭৫ তারিখে তারা স্বীকৃতি প্রদান করে)।
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যা ও অনাচার নিরসনের প্রয়াস নেন। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত করতে তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ গঠন করেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সার্থক রূপদানে বঙ্গবন্ধু ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সদ্য গঠিত জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। এই ব্যবস্থা চালুর পেছনে যে উপলব্ধিটি কাজ করেছে তা হলো বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা। স্বয়ংম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালা নতুনভাবে ঢেলে সাজানো। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র ঘোষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন, ক্ষেতখামার ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবীমহলকে ঐক্যবদ্ধ করে যে একক মঞ্চ তৈরি করেন সেই ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ এর তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। নতুন আশা উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে পৌঁছে দেবার জন্যে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতা-বিরোধী অশুভ শক্তির চক্রান্তের কারণে মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বাঙালি জাতির কলঙ্কময় দিন। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সপরিবারে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্রত্যক্ষ মদদে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। সশস্ত্র নির্মম গোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে নিরস্ত্র বঙ্গবন্ধু পিঠে নয়, বুকে গুলি খেয়েছেন। বাংলাদেশকে প্রাণের চেয়ে ভালবেসেই তিনি এই বীরত্বের পথটি বেছে নিয়েছিলেন। এই অবিস্মরণীয় জাতীয় বীরকে আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা দেখাতে কার্পণ্য করলেও ইতিহাসের রথযাত্রা কিন্তু থেমে নেই। আর সেই রথযাত্রার অগ্রভাগেই রয়েছেন তিনি। তিনিই আমাদের উপহার দিয়েছেন বহুকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। তাঁর কারণেই আজ আমরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি এবং বাংলাদেশ তাই এক ও অভিন্ন সত্তা। আক্ষরিক অর্থেই তিনি এবং বাংলাদেশ সমার্থক; শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়ানের পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরণের পরবর্তী অন্ধকার সময়ের চৌত্রিশ বছরে সে সব নির্মম পাষাণ ঘাতকের অধিকাংশের ফাঁসির দ- কার্যকর হওয়ায় গৌরব-দীপ্ত বাঙালি জাতি অনেকটাই শাপমুক্ত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছে মহীসোপানের সেই স্বর্ণসিংহাসন ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’। জয় হোক বঙ্গবন্ধুর। চিরজীবী হোক তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ।
ড. আতিউর রহমান, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।