জাতিসংঘে বাংলাদেশ ॥ বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন
বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ধারণাকে উর্ধে তুলে ধরে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প বিশ্বসভায় তুলে ধরেন।

আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন সানফ্রান্সিসকো নগরীতে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। জাতিসংঘের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি অকুণ্ঠ অঙ্গীকার রেখে ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ক‚টনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। মূলত, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নির্মাণে সচেষ্ট হন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু প্রবল প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও বাংলাদেশের জন্য একটি বলিষ্ঠ ও তৎপর পররাষ্ট্রনীতি কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ ছিল বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার অসাধারণ দক্ষতায় তা মোকাবেলা করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য চীন বাংলাদেশকে প্রথমত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তা সত্তেও অনানুষ্ঠানিকভাবে সেই দেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরকার সম্প্রীতিমূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলেন, যার জন্য চীনের ‘ভেটো’ প্রত্যাহার করিয়ে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছিল।’

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে উল্লাসমুখর পরিবেশে তুমুল করতালির মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন প্রিয় মাতৃভাষায়। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। সেদিনের সেই বক্তৃতাই ছিল আধুনিক বিশ্বে বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের প্রথম পদক্ষেপ। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বাঙালী জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনামলসহ বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালনার সময় যতবারই জাতিসংঘে কথা বলেছেন, ততবারই জাতিসংঘের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সনদের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকার বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এবারের ৭৩তম অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বপক্ষে তার অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তার সরকারের দৃঢ় সংকল্প তুলে ধরেন।
 
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সার্বিক অর্থে শান্তি ও ন্যায়ের সংগ্রাম হিসেবে অবহিত করেছিলেন। জাতির জনক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব- এ নীতিমালার ওপর ভিত্তি করেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বশান্তি আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকার জন্য ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভ‚ষিত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার সুফল ভোগ করা সম্ভব।

বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যা বতর্মান প্রধানমন্ত্রীও শান্তির প্রতি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ক‚টনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সময়ই নয়, বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভ‚মিকা পালনের সময়েও বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র, দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবাধিকারের ইস্যুতে শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার ভ‚মিকাও বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দেশের এক-দশমাংশে সুদীর্ঘ দুই দশকের রক্তপাত ও হানাহানি বন্ধ করেন। শান্তি প্রচেষ্টার এই উদ্যোগের কারণে ১৯৯৯ সালের ১ এপ্রিল তিনি ‘ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। নোবেল পুরস্কারের মতো মর্যাদাসম্পন্ন এই পুরস্কার বিশ্ব-পরিসরে খুব কম রাষ্ট্রনায়কই অর্জন করেছেন।

এছাড়া ১৯৯৬-২০০১ সময়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যার রাষ্ট্র পরিচালনার সময় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মর্যাদাপূর্ণ ‘সেরেস এ্যাওয়ার্ডে’ ভ‚ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর বিশেষ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আমাদের ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগে সমৃদ্ধ ২১ ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা দিবস। বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিয়ে আমাদের প্রিয় মায়ের ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জাতিসংঘে বার বার বাংলায় ভাষণ দিয়ে জাতিকে গৌরবান্বিত করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে পরিবেশ বিপর্যয়, এমডিজি, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে যেমন বক্তব্য রেখেছেন, তেমন রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রæত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তি অবিলম্বে কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে।’


 
শেখ হাসিনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বের নিপীড়িত শোষিত নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পিতার কাছ থেকেই মানবিকতার মহৎ গুণ অর্জন করেছেন তিনি। তাই তো বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গাদের মতো নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’

রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু-কন্যার দক্ষতা ও সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি অর্জন করেছেন এক মর্যাদার আসন। বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসনে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই কালিমা থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা শুরু করেছে। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার; বর্তমানে ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরে ছিল ৭.৮৬ শতাংশ। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ২১.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে হতদরিদ্রের হার ২৪ থেকে ১১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আক্রান্ত দেশের উন্নয়ন ফিরিস্তি জাতিসংঘে আগত নেতৃবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। দেশের অভাবনীয় এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করে আগামী নির্বাচনে বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখনই জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করেন, তখনই দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসেন। এবারও রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে মানবিক ও দায়িত্বশীল নীতির জন্য অনন্য নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মর্যাদাপূর্ণ ‘ইন্টারন্যাশনাল এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৮ স্পেশাল ডিস্টিংশন এ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং এ্যাচিভমেন্ট প্রদান করা হয়।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ লাইনে বঙ্গবন্ধু ‘সুন্দর ভাবীকালের’ স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এই লক্ষ্য পূরণে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। তেমনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আগামী প্রজন্মের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে এবং মানবতার পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
 
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
প্রকাশিত : ১ অক্টোবর ২০১৮

SUMMARY

2058-1.png