বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

ব্যারিস্টার হারুন-উর-রশীদ

১৯৭২ সালে আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পর আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) এবং আইন উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করি। আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন বিভাগ গোছানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যেটি অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি ও আইনি বিষয়গুলো দেখভাল করত।

তখন সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সংখ্যা ছিল অল্প। তাদের মধ্যে সচিব, যুগ্ম সচিব থাকলেও কোনো অতিরিক্ত সচিব ছিলেন না। একটু স্মরণ করলে দেখা যাবে, তখন ২৬ জনের বেশি যুগ্ম সচিব ছিলেন না, প্রতি মাসে যাদের বেতন ছিল ২৩ হাজার থেকে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটি বড় সুবিধা ছিল, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যুগ্ম সচিব সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারতেন। দাফতরিক কাজে বিশেষ করে ভারত ইস্যুতে আদেশ ও নির্দেশনা পেতে অনেকের সঙ্গে আমিও ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছি।

আলোচ্য লেখাটির পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি বর্ণনা করব, যেখানে বিভিন্ন ইস্যু খোলাসা করতে তার স্পষ্ট নির্দেশনাগুলো ফুটে উঠবে। নিঃসন্দেহে ওসব সিদ্ধান্ত তাত্ক্ষণিক হলেও দৃঢ় ও সুস্পষ্ট ছিল।

উল্লেখ্য, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো ছিল জটিল ও বহুমাত্রিক। অবশ্য অনেক ভারতীয় প্রতিনিধি ভাবতেন, বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন দেশ হওয়ায় দেশটির কর্মকর্তারা অভিজ্ঞ নন এবং তারা খসড়া চুক্তির জটিলতা বুঝবেন না। ভারতীয় প্রতিনিধিরা কমই জানতেন যে, বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু  নিয়ে আলোচনায় উপযুক্ত দক্ষতা ও সামর্থ্য অর্জন করেছেন। আমি একবার ভারতীয় প্রতিনিধি দলের একজন সদস্যের সঙ্গে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহে সমর্থ হবে না।

ভারতের সঙ্গে বিমান সেবা চুক্তি: ১৯৭৪ সালে দ্বিপক্ষীয় বিমান সেবা চুক্তি স্বাক্ষরে একদল ভারতীয় প্রতিনিধি এল, যে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান এবং এয়ার ইন্ডিয়া দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিমান পরিচালনা করতে পারবে। ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমিও ওই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলাম। আমরা ভাবলাম, বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে একজন সচিব যেহেতু নেতৃত্বে দিচ্ছেন, সেহেতু ভারতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদানে একজন যুগ্ম সচিব পাঠানো সঠিক হয়নি। আমার মতে, ভারতের দুটি সুযোগ বা অপশন ছিল— হয় প্রতিনিধি দলের প্রধানের পদমর্যাদা বাড়ানো নতুবা বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে সমান পার্টনার ভেবে যথাযথ সম্মান প্রদানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে মনোনয়ন দেয়া। কিন্তু দেখা গেল, ভারতীয় আমলারা এর কোনোটাই করেননি। যদিও এটাকে খুবই ক্ষুদ্র বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, তথাপি এর মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের প্রতি তাদের ‘বড় ভাই সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রদর্শন করেন।

প্রথম বৈঠকের দিনেই ভারতীয় প্রতিনিধি দল বিমান সেবা চুক্তির একটি খসড়া আমাদের কাছে সার্কুলেট বা প্রচার করেছে। ওই খসড়া পড়ে আমি উপলব্ধি করলাম, এটা বাংলাদেশের মতো সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। পেশাগতভাবে লন্ডন থেকে বার-এট-ল পড়ার সুবাদে দুটি সার্বভৌম দেশের বিমান সেবা চুক্তির স্ট্যান্ডার্ড বিষয়-সূচি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান ছিল। সাধারণভাবে বিমান সেবা চুক্তি বিমানের ‘পাঁচটি স্বাধীনতা’ ধারণ করে, কিন্তু আলোচ্য খসড়ায় ‘চারটি স্বাধীনতা’ ছিল। বিমানের পঞ্চম স্বাধীনতা বাদ দিয়ে দেয় ভারত।

যখন একটি এয়ারলাইন চুক্তিবদ্ধ দেশের মধ্য দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে যেতে পারে, কারিগরিভাবে সে অধিকারকে ‘পঞ্চম স্বাধীনতা’ বলে; যে অধিকারবলে বিমান-রুট কেবল দুই দেশের শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চম স্বাধীনতাবলে বাংলাদেশ বিমান ভারতের মুম্বাই-দিল্লির মাধ্যমে লন্ডন কিংবা প্যারিসে যাওয়ার অনুমতি পাবে।

ওই বিষয়ে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বললাম, আসলে খসড়া প্রণয়নে ভুলক্রমে পঞ্চম স্বাধীনতার বিষয়টি বাদ পড়ে গেছে কিনা। আরো বললাম, খসড়াটি সব স্বাধীনতা ধারণ করছে না। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের প্রধান প্রত্যুত্তরে বললেন, তাদের খসড়ায় সব ঠিক আছে এবং তা উভয় দেশের প্রত্যাশা পূরণ করবে।

আমি বরং ভারতীয় প্রতিনিধি দলের প্রধানের নৈমিত্তিক বা স্বাভাবিক আচরণে বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভারতীয় প্রতিনিধি দল এমন একটি খসড়া নিয়ে হাজির হলো, যেটা বাংলাদেশী বিমানকে সে দেশের কোনো শহর থেকে অন্য দেশে বিমান চলাচলের অনুমতি দেবে না। বিমানের নির্ধারিত ফ্লাইটগুলো কেবল দুই দেশের শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমাদের প্রতিনিধি দলের প্রধানকে কয়েক ঘণ্টার অভ্যন্তরীণ আলোচনার জন্য বৈঠক স্থগিত করতে আমি অনুরোধ করলাম। আমার অনুরোধে যথারীতি স্থগিত করা হয় বৈঠক এবং মাত্র ১ ঘণ্টার ব্যবধানে বৈঠক স্থগিত হওয়ায় ভারতীয় প্রতিনিধি দল খানিকটা বিস্মিত হয়েছিল। ঢাকাভিত্তিক একজন ভারতীয় কূটনীতিককে ইঙ্গিত দিলে দেশটির প্রতিনিধি দল উপলব্ধি করল, তাদের দিক থেকে কিছু ভুল আছে। কিন্তু তারা চুপ রইলেন। কেবল জিজ্ঞেস করলেন, বিকালে আমরা আবার কখন বৈঠক করব। আমরা তাদের বললাম, ৩টায় আবার বৈঠকে বসব।

এরই মধ্যে আমরা সবাই তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী এমএজি ওসমানীর বাসায় গিয়ে তাকে সবকিছু খুলে বললাম। আমরা যা বললাম, তিনি তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে আচরণ করছে, তাতে অবাক হলেন। যোগাযোগমন্ত্রী তাত্ক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং তিনি আমাদের সঙ্গে শিগগিরই দেখা করতে সম্মত হলেন।

আমরা সরাসরি গণভবনে (রাষ্ট্রপতি ভবন) বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, যেখানে তিনি রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী দুপুরের খাবার সেরে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেন। আমরা বৈঠকের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করলাম এবং পরামর্শ দিলাম ভারতীয় খসড়ার ভিত্তিতে আমাদের আলোচনায় এগোনো ঠিক হবে না। আমাদের কাছ থেকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের কৌশল জেনে মনে হলো প্রধানমন্ত্রী হতাশ হলেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা বন্ধের কৌশল তিনি অনুমোদন দিলেন এবং সমর্থন করলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘তাদের তেজগাঁও বিমানবন্দর দেখাও।’ তিনি কী বুঝিয়েছিলেন তা আমরা বুঝেছিলাম। বিকালে আমরা আলোচনার টেবিলে ফিরে এলাম এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদের বললাম, ওই খসড়া বাদ দিয়ে এমন একটি খসড়া তৈরি করতে, যা সব স্বাধীনতা ধারণ করবে। ভারতীয় প্রতিনিধিরা যেহেতু বিদ্যমান খসড়ায় ‘পঞ্চম স্বাধীনতা’ অন্তর্ভুক্তিতে রাজি ছিলেন না, সেহেতু কোনো চুক্তি ছাড়াই তাদের ঢাকা ত্যাগ করতে হয়েছিল। অবশেষে প্রায় এক বছর পর বাংলাদেশ বিমানের সব স্বাধীনতা মেনে নিয়ে আমাদের সঙ্গে বিমান সেবা চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত। এটা হতে পারে, ভারতীয় আমলারা বিশ্বাস করেননি আমাদের দ্বারা এভাবে ধরা খাবেন। সম্ভবত তারা ভেবেছিলেন, খসড়ায় পঞ্চম স্বাধীনতার বিষয়টি অনুপস্থিত থাকলে আমরা বিষয়টি আলোচনায় তুলব না।

গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি: বাংলাদেশ-ভারতের অধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ইস্যু হলো গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি। এবার দেখা যাক, কীভাবে এবং কত মাত্রায় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচ্য ইস্যুর রেজুলুশন প্রক্রিয়া ডিল করতে অসমর্থ হয়।

বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়ার আগে গঙ্গা নদী নেপাল, ভারত এবং বাংলাদেশ তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী নিজেদের জীবিকা নির্বাহে গঙ্গা নদীর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে পানির চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই কৃষি, নেভিগেশন ও শিল্প-কারখানার কাজে প্রয়োজন। অধিকন্তু নদীর প্রবাহ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার প্রকোপ প্রতিরোধ।

ভারত চূড়ান্ত পর্যায়ে কলকাতার কাছে হুগলি নদীর পলি সাফ করার উদ্দেশ্যে গঙ্গার পানির প্রবাহ পরিবর্তনে ফারাক্কায় (বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ১১ মাইল) বাঁধ নির্মাণ করে। নদীগুলোয় লবণাক্ততা বাড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উত্পাদন কম হবে, নৌচলাচল ব্যাহত হবে এবং সর্বোপরি বনভূমি কমবে বিধায় এটা বাংলাদেশের দিক থেকে বড়ই উদ্বেগের ছিল।

অনেক পানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রয়োজনের অনিবার্যতা বিবেচনার বিপরীতে হুগলি নদীর পলি অপসারণে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার আসলে পানির অপব্যবহার। গঙ্গা নদীর পানির ঐতিহ্যগত প্রবাহ হারানো পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নদীর নাব্যতা রক্ষা ও সেচের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের দিক থেকে বলা হয়েছিল, কেবল গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হলেই ভারত বাঁধ চালু করতে পারবে, যাতে পানির প্রবাহ পরিবর্তন বাংলাদেশে কমই প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে।

ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ: সবাই অবগত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়েই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত ধাপে ছিল। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের সঙ্গে চরম শত্রুতার উত্তুঙ্গ সময়ে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের পানির প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় না নিয়েই ভারতের পক্ষ থেকে ফারাক্কা বাঁধের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কতিপয় ভারতীয় বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলগত দিক থেকেও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণকে খারাপ পরিকল্পনা হিসেবে দেখেন। কেননা ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রবাহের পরিবর্তন কৃষিজমিতে সেচের চেয়ে হুগলি নদীর বালি অপসারণে বেশি প্রয়োজন।

ভারত ১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্যও অপেক্ষা করেনি। মনে হয়, ভারত আলোচ্য প্রকল্পে প্রকৌশলীদের মতামত উপেক্ষা করেই বাঁধটি নির্মাণে বদ্ধপরিকর ছিল। ভারত আলোচ্য প্রকল্পে কতিপয় প্রকৌশলীদের সমালোচনামূলক মতামত আমলে নেয়নি। একজন ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্য লিখেছেন, গঙ্গার পানির প্রবাহ পরিবর্তনের মাধ্যমে হুগলির পলি অপসারণ ‘অভ্যন্তরীণ জলপথ ও কলকাতা বন্দর’ রক্ষায় তেমন ভূমিকা রাখবে না।

২০০৪ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, কপিল ভট্টাচার্যই সঠিক। কেননা আলোচ্য বাঁধ পশ্চিম বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার বহু মানুষের জন্য দুঃখ বয়ে নিয়ে এসেছে। এটা বোধগম্য যে, বাঁধ নির্মাণকাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকায় স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারত তা বন্ধ করতে পারেনি। অবশ্য বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে বাঁধের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশটি বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ দেখবে।

১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় গঙ্গায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার সময় ‘পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পানি বণ্টনের’ কথা বলা হয়। একই বছরের জুলাইয়ে মন্ত্রিপর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও বাঁধ চালুর আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছার বিষয়ে সম্মত হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতির তোয়াক্কা না করে গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যার কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারত যখন শুষ্ক মৌসুমে (এপ্রিল-মে) টেস্ট-রান হিসেবে বাঁধ চালু করে তখন বাংলাদেশ বেশ অবাক হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল গঙ্গার পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিতে আবারো ঢাকায় মন্ত্রীপর্যায়ে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রশ্ন তোলে যে, ভারত ১৯৭৪ সালের দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। অবশ্য ভারত বলেছে, বাঁধ কেবল পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। সুতরাং পানি প্রত্যাহার প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণা ভঙ্গ করে না।

ভারতের নতুন অবস্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভারতের দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা না হলে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীর সঙ্গে কীভাবে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ও নির্ভরশীল সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে?

১৯৭৫ সালে ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ যখন দেখল, ভারত চুক্তি ছাড়াই পরীক্ষামূলকভাবে বাঁধ চালু করে তখন দেশটি তাতে সম্মত হতে বাধ্য হলো। বাঁধ ও ফিডার ক্যানেল উভয়ই ভারতের ভূখণ্ডে অবস্থিত। এভাবে ‘মুখ রক্ষার উপকরণ বা ডিভাইস’ হিসেবে ভারতের প্রস্তাব মেনে নেয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো পছন্দ দিলনা।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা-সংক্রান্ত আলোচনা: দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্র সীমানা-সংক্রান্ত আলোচনা উপলক্ষে আমি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মিয়ানমারে গিয়েছিলাম। আমি তখন প্রধান সচিব আবদুর রহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তিনি ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন।

ওই তারিখে বিষয়টি ব্রিফ করার জন্য আমি গণভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে দেখা করলাম এবং তার অনুমোদন নিলাম। আমি বিস্তারিতভাবে আমাদের আলোচনার কৌশল ব্যাখ্যা করি এবং তিনি দ্রুত অনুমোদন দেন। আমি কমই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট খুন হবেন। সেদিনই তাকে শেষবার দেখেছিলাম। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর আমাদের মিয়ানমার সফর বাতিল করা হয়েছিল।

ব্যক্তিগতভাবে আমি বলতে পারি, যখনই দাফতরিক বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতাম, দেখতাম তিনি খুব দ্রুত ও স্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন কট্টর জাতীয়তাবাদী। এক্ষেত্রে উপরে বিধৃত বিমান সেবা চুক্তির বিষয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। সে সময় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের বিরক্তির বিপরীতে তিনি আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। মিয়ানমার বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ব দিতেন বঙ্গবন্ধু।

লেখক: জেনেভায় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

SUMMARY

2056-1.jpg