মোহাম্মদ জমির
তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উত্তাল সমুদ্রে শুধু নিরাপদ সঠিক পথের দিশাই দেননি বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফেরার পথে সৌভাগ্যবশত আমার সঙ্গে তাঁর লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে দেখা হয়। আমার সাবেক কর্মস্থল ছিল মিসরের কায়রোয় পাকিস্তান দূতাবাসে। যুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে এসে লন্ডন শহরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলাম। এর আগেও তাঁর সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু এবারের বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরাসরি তার কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিকল্পনা শুনেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কি লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চাই নাকি দেশে সরাসরি তার তত্ত্বাবধানে থেকে নবগঠিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে চাই। আমি দ্বিধাহীনভাবে জানালাম, তার তত্ত্ব্বাবধানে ঢাকায় থেকে বাংলাদেশের জন্য নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনে অংশীদার হতে চাই। তিনি তত্ক্ষণাত্ রাজি হয়ে গেলেন এবং দ্রুত দেশে ফিরে আসার সব প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে আমাদের নবগঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলাম।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারিতেই নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে এ অবিসংবাদী নেতা নতুন দেশ নিয়ে তার পরিকল্পনা জানান। স্বাধীন বাংলাদেশে এ যাত্রাকে তিনি ‘দাসত্বমুক্তি ও নতুন আশা নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা’ নামে অভিহিত করেন। তিনি আরো বলেন, ‘কারো প্রতি অন্তরে ঘৃণা নিয়ে নয় বরং মিথ্যাকে হটিয়ে সত্যের জয়, মানসিক সুস্থতা, কাপুরুষতার বিরুদ্ধে বীরোচিত জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও মন্দের বিরুদ্ধে ভালো কিছু করার তৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরছি।’
১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুবক্তা ও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন। স্বভাবসিদ্ধ কর্মতত্পর ভঙ্গিতে জয়ী বাংলাদেশীদের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন। এত আনন্দোত্সবের মধ্যেও অবাঙালিদের ওপর কোনো রকম হামলা না করার ব্যাপারে সাবধান করে দিতে ভুললেন না। একই সঙ্গে পাকিস্তানে অবস্থানরত চার লাখ বাঙালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। নতুন করে দেশ গঠনের প্রাক্কালে তিনি স্পষ্ট করেই ইঙ্গিত দেন, পাকিস্তানিদের প্রতি কোনো শত্রুতা নেই; কিন্তু যারা নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে। ‘বাংলাদেশে ইসলাম বিলুপ্ত হচ্ছে’ পাকিস্তানিদের ক্রমাগত এ মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে তিনি সচেতন ছিলেন। একই বক্তব্যে মুসলিম দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ।’ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরো বলেন, ‘ইসলামের নামে পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের মুসলিমদের হত্যা করেছে। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। আমি এ দেশে ইসলামকে অসম্মানিত হতে দেব না।’ তার এ বক্তব্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি তার দৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অনাচারের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন।
ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশে অবস্থিত ‘বিহারি এবং অবাঙালি মুসলিমদের’ জন্য তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল টেংকু আবদুর রহমানকে একটি তিরস্কারসূচক বার্তা পাঠান। বার্তায় বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের নয় মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ৩০ লাখ নিরীহ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিরীহ মুসলিমদের হত্যার ঘটনায় অন্যান্য মুসলিম সংগঠন এবং আপনারা চুপ ছিলেন।’
পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের পর ১৯৫ জনকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৩ ভঙ্গ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যুতে গোটা বিচার প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর অনেক নিন্দুক ছিলেন। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে নিয়োজিত দল হিসেবে আখ্যা দেয়। এমনকি ভারতের জন্য নিজের দেশের স্বার্থও জলাঞ্জলি দিচ্ছে— এমন কথাও রটায়। অথচ এসবই ছিল সত্য থেকে অনেক দূরে।
বাংলাদেশে ভারতের সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদানের জন্য বন্ধবন্ধু তাদের ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে জরুরি পরিস্থিতি অবসানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে তাদের চলে যাওয়ার অনুরোধও জানান। তত্কালীন পাকিস্তানি নেতারা প্রচার করেন বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের অনেকে তা বিশ্বাস করে কিছুটা ভীতও হয়। কিন্তু সেটি ঘটেনি।
বঙ্গবন্ধুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ ও ভারত ফেরত শরণার্থী বাংলাদেশীদের মানসিকভাবে সাহসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিশ্চিত করেন কলকাতা থেকে ৭০ লাখ শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিরা নতুন করে সবকিছু শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরে আসে। এত বিরাট সংখ্যক মানুষকে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা কষ্টকর ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার দল জাতিসংঘের সাহায্যে এ কাজ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে প্রতিটি জাতির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারতীয় ডেস্কের পরিচালক থাকার সুবাদে ভারত ও বাংলাদেশের সমান বাণিজ্যিক সুবিধা এবং সহযোগিতার নিশ্চয়তার জন্য তাকে কতটা চাপের মুখে থাকতে হয়েছিল তা দেখেছি। তিনি সহযোগী মনোভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন। সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের মানুষের সুবিধার জন্য একটি গতিশীল উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রায় চার দশক পর আজকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আমরা আঞ্চলিক গ্রিড ও আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনার কথা প্রস্তাব করছি। অথচ বঙ্গবন্ধুর এমন চিন্তাধারা ছিল বহু বছর আগেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু গভীর আগ্রহ ছিল। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে শুধু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিচিতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনই নয় বরং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর সদস্যপদ লাভের জন্যও যোগ্য হয়ে উঠতে বলেন। তার প্রতিটি বৈদেশিক ভ্রমণের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকত সেই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব গড়ে তোলা। তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপরাপর দেশের অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধসহ পারস্পরিক শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সমান অধিকার নিয়ে নিজস্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব।
তার এ দৃঢ়চেতা মনোভাব আমাদের দ্রুতই আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক নির্মাণে সাহায্য করেছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময়ে বিশ্বের ৫৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। ’৭২-এর শেষ দিকে এসে সংখ্যাটি বেড়ে যায়। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আইএলও, ডব্লিউএইচও প্রভৃতির সদস্য হয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে থাকলেও চীনের ভেটো ক্ষমতার কারণে সদস্যপদ লাভ করতে পারিনি। এটা বঙ্গবন্ধুকে খুব হতাশ করে। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে বেশ কয়েকবার চীন ভ্রমণ করেন এবং যেকোনো ঘটনায় চীনকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করতেন।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন ড. কুর্ট ভাল্ডহাইম। সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ২৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মানবিক সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি এটা করেছিলেন কারণ পাকিস্তান এ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত চাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর এ আচরণ থেকে বোঝা যায় তিনি দেশের মানুষকে কতটুকু ভালোবাসতেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণ আমাদের সঙ্গে রাশিয়া, পূর্ব- ইউরোপ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনভুক্ত ও কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছিল। তার এ কর্মকাণ্ডের ফলে ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়া ও মিসরের যুদ্ধে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সিনাইয়ে অবস্থানরত মিসরীয় সৈন্যদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি মেডিকেল টিম ও চা উপহার হিসেবে পাঠান তিনি। দূরদৃষ্টি ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের জন্য সৌদি আরব, কুয়েত, মিসর, আলজেরিয়া ও সিরিয়া বাংলাদেশকে ‘ওআইসির’ সদস্যপদ লাভে সহায়তা করেছিল। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যও তারা জোর দিয়েছিল। আমার আরবি ভাষায় দক্ষতা থাকা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য এ দুটি পদক্ষেপেই সরাসরি যুক্ত হতে পেরেছিলাম। এটা আমার জন্য পরম গৌরবের বিষয়।
তিনি একজন আত্মত্যাগী মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি, তার সব উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনাশ করে ফেলা হয়। তার অকালে চলে যাওয়া আমাদের শাসন ব্যবস্থায় অনেক অপতত্পরতার উন্মেষ ঘটায়। যার মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে, জবাবদিহিতার অভাব। তার স্মৃতির প্রতি ঋণী থেকে সব নাগরিকের সমঅধিকার ও সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে আমাদের প্রত্যয়ী হতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক
mzamir@dhaka.net