ড. আতিউর রহমান
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ের বেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় ফেরেন। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে জিতলেও তার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ অনুভব করতে পারছিলেন না। বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ সারা বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের জোরালো দাবির কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান। মুক্তি পেয়েই তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তার আগমন ছিল আমাদের স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভের এক আবেগময় মুহূর্ত। ঢাকায় পৌঁছেই তিনি লাখ লাখ মানুষের মাঝে মিশে যান।
ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি সেদিন বিকেলে বক্তৃতা দেন। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, বাঙালি সত্যিই মানুষ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যে খেদ ‘বাঙালিকে মানুষ করোনি’ তা যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, সে কথাটিই তিনি সেদিন জোর দিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট কালো রাতে বাঙালি ঠিকই ফের প্রমাণ করল, তারা অমানুষই রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথই যথার্থ ছিলেন। ওই কালো রাতে বাঙালি জাতির জনককে শুধু নয়, তার পরিবারের শিশুপুত্রসহ কাউকে রেহাই দেয়নি অমানুষ ঘাতকের দল। তার সেই হঠাৎ চলে যাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই যেন আঘাত করেছিল। এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে দুই দশকেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দীর্ঘ বন্দিজীবন শেষে স্বদেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই তিনি দেশের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলেন। সে সময় দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিয়ে স্বদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনে তিনি হাত দিয়েছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু রাত-দিন পরিশ্রম করে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলপথ, সড়কপথ, সেতু ও কালভার্টসহ সব ভৌত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পুনরায় চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাতে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত গেলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১ মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করে। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। একই সাথে চলে সর্বব্যাপী পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ।
বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী গঠন, পুলিশ এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণীতে নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ; মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারীকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে পুনর্বাসনব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকদের মাঝে দেড় লাখ গাভী ও ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ এবং ব্যাপক কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেয়ার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছিলেন।
বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ এবং সেগুলো চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, বাংলাদেশ ব্যাংক নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ কলকারখানা চালুসহ সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বল্পসময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করা তার সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য।
স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপগুলো আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলব্যবস্থার উন্নয়ন, টেলিযোগাযোগ পুনর্গঠন, দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, উত্তর-দক্ষিণ শীতল রাজনৈতিক মেরুকরণে দেশকে ‘জোটনিরপেক্ষ- সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ নীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা, পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন, আদমশুমারি ইত্যাদি কর্মপ্রয়াসে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তার এই ব্যাপক তৎপরতার দ্রুতই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে।
১০ অক্টোবর ১৯৭২ ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে বিশ্বশান্তি পরিষদের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২৩ মে ১৯৭৩ বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করেন পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র। স্বদেশেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরন্তর কাজ করে গেছেন।
তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক করে ভাবতেন। তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করে গেছেন সব কিছু। অহিংস আন্দোলনের পুরোধা মহাত্মা গান্ধী যা করে দেখাতে পারেননি, বঙ্গবন্ধু তা করে দেখিয়েছেন। গান্ধীজী সাম্প্রদায়িকতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে ছিল না কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ। সত্যিকার অর্থেই আধুনিক মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল এক অনন্য ঘটনা। আর এ ঘটনার মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর মানবিক চেতনা।
এত কিছুর পরও তিনি বাংলাদেশের সব নাগরিককে, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়ের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছিলেন না। আর ষড়যন্ত্রকারীরা সামাজিক এ অস্থিরতার পুরো সুযোগ নিচ্ছিল। অযথা অশান্তি সৃষ্টি করছিল। এমন বিধ্বস্ত দেশে কোথাও কোথাও খাদ্যসহ নিত্য ঘাটতি থাকতেই পারে। সেই সীমাবদ্ধতার তিলকে তাল করে সারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বহু গোষ্ঠী। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যা ও অনাচার দূর করায় উদ্যোগী হন। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত করতে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ গঠনের ঘোষণা দেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সার্থক রূপদানে তিনি ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে নিজে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সদ্য গঠিত জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নেতার প্রতি আহ্বান জানান।
এ ব্যবস্থা চালুর পেছনে যে উপলব্ধি কাজ করেছিল, তা হলো বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা এবং তা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালা নতুনভাবে ঢেলে সাজানো। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র ঘোষণা দেন, যার লক্ষ্য ছিলÑ দুর্নীতি দমন, ক্ষেতখামার ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। নতুন আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তির চক্রান্তের কারণে মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যসহ চক্রান্তকারীদের প্রত্যক্ষ মদদে, সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী বিশ্বাস ঘাতক অফিসারের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। তিনি স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশবাসীকে এই বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যে, ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব’ (বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ, ২৬ মার্চ ১৯৭২), সেই তিনিই হারিয়ে গেলেন ষড়যন্ত্রকারীদের বুলেটের আকস্মিক আঘাতে। শারীরিকভাবে চলে গেলেও তিনি আছেন আমাদের অন্তরে অন্তরে। থাকবেন চিরদিন আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
ই-মেইল : dratiur@gmail.com