এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-সৈয়দ মফিজুর রহমান


জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন ৭ মার্চ। আমাদের ৬ ও ১১ দফা, স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে বেগবান করে, ৭ মার্চের ভাষণ এটাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তিত করে। ৭ মার্চের ভাষণে আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ স্বাধীন করার... ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুÑ আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’ বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন করার দিকনির্দেশনা ও পন্থা বলে দেন। সেসময় বাঙালির জাতীয় প্রেক্ষাপট হলো ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচনে বিজয়, ’৬৯-এর অভ্যুত্থান আর ’৭০-এর নির্বাচনী বিজয়। এ চারটি বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তিনটি ষড়যন্ত্র পাকিস্তানিরা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানো এবং ’৭০-এর নির্বাচনী বিজয় বানচালের জন্য ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দেওয়া। এ ছাড়া পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগ।

৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। গণপরিষদে সংবিধান রচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫৬ দিন। পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রে প্রথমে ইস্কান্দর মির্জাকে গভর্নর করে পাঠানো হয়। পরে আইয়ুব খানের সামরিক হস্তক্ষেপে ’৫৪-এর বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেন। এটি ছিল স্বশাসনের প্রস্তাব। এটি নস্যাৎ করতে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ৫৪ সালের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার পর এটি ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র। ৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পতন ঘটে এবং আইয়ুব খানের সংবিধান বাতিল হয়ে যায়। ‘এক মাথা এক ভোট’ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, গণপরিষদে সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সংবিধান রচনায় যাতে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার বিধিবদ্ধ থাকে, সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনকে গণরায়ে পরিণত করলেন, গণপরিষদে অর্জন করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সরকার গঠন। তাই ’৭০ সালের নির্বাচনটি কোনো গতানুগতিক নির্বাচন ছিল না। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দেখল, গণপরিষদে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করবেন, বাঙালিরা স্বশাসন পাবে। শুধু অভিন্ন প্রতিরক্ষা আর পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া পূর্ব বাংলা চলবে নিজের মতো। তারা তা হতে দিতে পারে না। আর এজন্যই ১ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন বসার কথা থাকলেও ইয়াহিয়া খান তা নাকচ করে দিয়ে অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। এভাবেই আবার ছিনতাই হয়ে যায় বাঙালির গণরায়। তখন সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। সুতরাং ৭ মার্চ তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়ালেন, তখন স্বাধীন বাংলার পতাকা এসে গেছে। জাতীয় সংগীত এসে গেছে। এসে গেছে স্বাধীনতার ইশতেহারও। ৮ মার্চ থেকে তিনি অসহযোগের ডাক দেন। এই অসহযোগ গান্ধীর অসহযোগ নয়, দেশের কর্তৃত্বই নিয়ে নিলেন। কীভাবে অফিস, আদালত, ব্যাংক চলবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে কাজ করবে, জনগণ কী করবেÑ সব নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। পূর্ববাংলার রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই পাকিস্তানি নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর জারিকৃত ফরমান অনুযায়ী চলা শুরু করে। ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু দুটো সংগ্রামের কথা বলে বাঙালি জাতিকে নিয়ে তার দর্শন তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’

ভৌগোলিক স্বাধীনতার সঙ্গে তিনি শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামের কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষ ও সমাজের মুক্তির কথা বললেন তিনি। ২৫ মার্চের রাতে বাংলাদেশ আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের চার নম্বর চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু এই চক্রান্ত আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন এর আগে ’৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের বিজয় কীভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, ’৬৬ সালে তাকে মিথ্যা মামলায় হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছে আর ’৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও বাঙালিদের গণপরিষদে বসতে দেওয়া হয়নি। অতীতের তিন চক্রান্তের জালে বাঙালিদের আটকে রাখলেও আর কোনো চক্রান্ত যাতে বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে না পারে, সেজন্যই ৭ মার্চ মঞ্চে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালিরা যাতে সরাসরি চক্রান্ত বানচাল করে স্বপ্নের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে, ভাষণে সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথ দেখালেন তিনি। আর পিছু ফেরা নয়, আর বঞ্চনা নয়, এবার স্বাধীনতা, এবার মুক্তি।

প্রায় সাড়ে ৪৬ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ অমূল্য বিশ্বসম্পদ ও ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তা সংরক্ষণ করার এবং বিশ্বকে জানানোর দায়িত্ব নিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো)। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর সেই মহাকাব্যিক দৃপ্ত উচ্চারণ আগে থেকে লেখা ছিল না। বরং তা ছিল মুক্তিকামী বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক এক তাৎক্ষণিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ স্থান দিয়েছে ইউনেসকো। এ প্রসঙ্গে ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে লিখেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে আমরা এত দিন যা বিশ্বাস করেছি এ ভাষণটি আমাদের স্বাধীনতার প্রেরণা। এ ভাষণ আমাদের একটি দেশ দিয়েছে, দিয়েছে আত্মমর্যাদা। এ ভাষণ আমাদের হৃদয়কে শক্ত-সবল করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে। এ ভাষণ শুনে যুদ্ধকালীন বাঙালি হতাশা বা নিরাশা কাটিয়ে আবার চাঙা হয়ে উঠত। এই বক্তৃতার আলাদা ক্ষমতা আছে, শক্তি আছে, প্রেরণা আছে। আমরা বহু রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশ্বের খুব কম দেশই আছে যেখানে মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাই আমাদের স্বাধীনতার আলাদা মর্মার্থ রয়েছে। রক্ত কারা দিয়েছে? অনেকেই হয়তো ভাববেন ১৯৭১ সালে দুই দেশের উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, মুজিবনগর সরকারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল না। কিন্তু যুদ্ধে এক পক্ষে ছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, আরেক দিকে ছিল বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-দিনমজুর খেটে খাওয়া আমজনতা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ। সাধারণ মানুষই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। ৭ মার্চের ভাষণে দুটো বিষয় ছিল। একটি হলো স্বাধীনতা, আরেকটি হলো মুক্তি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন আমাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। মুক্তি হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, যেখানে সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। যেখানে ধনী-দরিদ্রের পর্বতসম ফারাক থাকবে না। প্রত্যেকের সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আইন সবার জন্য সমান হবে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন। এটা আমাদেরও স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন সরকারে অনেক কিছুই করেছেন, কিন্তু যে জিনিসটি করে তিনি আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন, তা হচ্ছে তার সোনার বাংলার স্বপ্ন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছেন। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কয়েকটি রোডম্যাপ দিয়েছেন। ২০২১ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হব, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জন, ২০৪১ সালে আমরা একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী-অসাম্প্রদায়িক-স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হব। এসব লক্ষ্য অর্জনে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মিত হবে।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সামুদ্রিক মৎস্য দফতর, চট্টগ্রাম

SUMMARY

2052-1.gif