এ কে এম আতিকুর রহমান
বর্তমান বিশ্বেই নয়, প্রাচীনকালেও রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের বা কোনো ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তত্পরতার প্রচলন ছিল। ওই সময় প্রয়োজন হলেই (সংকটে বা আনন্দে) রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বিশেষ দূত হিসেবে অন্য রাষ্ট্রে প্রেরণ করতেন। দূত সাধারণত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বয়ে নিয়ে যেতেন। দূতের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো যে উদ্দেশ্যে তাঁকে প্রেরণ করা হতো তাকে ঘিরে। উদ্দেশ্য সাধিত হোক বা না হোক, এমনকি ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও দূতের ওপর সাধারণত কোনো বিপদ নেমে আসত না। পরবর্তী সময়ে ওই প্রথাই আধুনিক কূটনীতির অবয়ব ধারণ করে। আর রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রয়োজন পড়ে বিদেশ বা পররাষ্ট্রনীতির।
একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি গুণনীয়ক। একটি রাষ্ট্রের জন্য এ দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতার ওপরই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্রের সাফল্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এর কোনো ব্যতিক্রম দেখি না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে মুক্ত হয়ে বিশেষ বিমানে পরের দিন ভোরে লন্ডন পৌঁছেন। বিমানে চেপে যখন তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যাচ্ছিলেন, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা নিয়ে নানা চিন্তা-ভাবনা। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি বৈঠক করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য ও লাখো ভারতবাসী।
দেশের মাটিতে পা রেখেই দেখলেন চারদিকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো অর্থ নেই। ওই অবস্থায় কাঁধে তুলে নিতে হলো দেশ ও মানুষের এক গুরুদায়িত্ব। সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। এক ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে দাঁড়িয়ে যে কঠিন দায়িত্ব সেদিন তিনি নিয়েছিলেন বা জাতি তাঁকে দিয়েছিল, তা একমাত্র তাঁর মতো অসম সাহসী দেশপ্রেমিক নেতার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব।
আত্মপ্রত্যয়ী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সেই মানুষটি দেশ গড়ার কাজে লেগে গেলেন। দেশের জন্য রচিত হলো সংবিধান। আর সেই সঙ্গে প্রণয়ন করা হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। তাঁর দেওয়া পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা—‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এবং ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’-এর ওপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজের সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এখন সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই বাংলাদেশের রয়েছে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক।
বঙ্গবন্ধু শুধু নিজের দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবেননি, তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন সারা বিশ্বের নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বটা দুভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।’ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো ধর্ম বা বর্ণের মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। মূলত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন বিশ্ব নেতা যিনি সব সময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তাঁকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উত্খাতের নিন্দা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতা সফরে যান। দমদম বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সফরকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে মার্চের মধ্যে সব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত ১ মার্চ বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় এবং ১৫ মার্চের মধ্যেই ওই প্রত্যাহার সমাপ্ত হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি মস্কোর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং শান্তি বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। লন্ডনে চিকিৎসাকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অপারেশন-পরবর্তী বিশ্রামের জন্য ২১ আগস্ট লন্ডন থেকে তিনি সুইজারল্যান্ডের অতিথি হয়ে জেনেভা যান। সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর ১৩ সেপ্টেম্বর সেখান থেকে দেশে ফেরার পথে নয়াদিল্লিতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ (১৭ মে), আইএলও (২২ জুন), আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন (২০ সেপ্টেম্বর), ইউনেসকো (১৯ অক্টোবর), কলম্বো প্ল্যান (৬ নভেম্বর) ও গ্যাটের (৯ নভেম্বর) সদস্য পদ লাভ করে। ৮ আগস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদন পাঠায়। দুই দিন পর বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যকে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য অনুরোধ করে পত্র লেখেন। ২৩ আগস্ট যুক্তরাজ্য, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া এক মিলিত প্রস্তাবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে জোরালো সুপারিশ করে। তবে চীন ওই প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ৩০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ প্রস্তাবটি সুপারিশ করে।
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবি জানায়। ২৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্যাট্রিস লুলুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ২৬-৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটোর আমন্ত্রণে যুগোস্লাভিয়া সফর করেন। সফরকালে প্রেসিডেন্ট টিটো ন্যাম ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন জানান। বঙ্গবন্ধু অটোয়ায় ২-১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে কানাডা সফর করেন। তিনি ৫-৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ওই সময় তিনি বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, প্রধানমন্ত্রী তাকেদ্দিন স্লথ প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৮ অক্টোবর সাত দিনের এক সফরে টোকিও গমন করেন। ওই বছর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে যেমন ভালোবাসত, বঙ্গবন্ধুও তেমনি তাদের ভালোবাসতেন। তাই তিনি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের অনতিবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য এপ্রিলে জাতিসংঘের মহাসচিবকে বার্তা পাঠান। মে মাসে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশ সফরে এলে বঙ্গবন্ধু তাঁকেও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বাঁচানোর জন্য বলেন। ২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালি ও পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু চুক্তিটিকে অভিনন্দন জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ বাঙালিদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৬৮ জন বাঙালির একটি দল বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হয়।
২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভিয়েতনামের শান্তিচুক্তিকে অভিনন্দন জানান। ওই বছর বাংলাদেশ এডিবি (১৮ ফেব্রুয়ারি), আইসিএও (২৮ ফেব্রুয়ারি), ইকাফ (২৩ এপ্রিল) এবং ফাও (১২ নভেম্বর)-এর সদস্য পদ লাভ করে। মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের তিন দিনের এশিয়া কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধুকে শান্তির জন্য জুলিও কুরি স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। ১০ জুলাই পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে। বাংলাদেশ মোজাম্বিকে পর্তুগালের নৃশংসতার তীব্র নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ ২১ জুলাই সরদার মোহাম্মদ দাউদ খানের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকেও স্বীকৃতি প্রদান করে। ৩ সেপ্টেম্বর ন্যাম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ন্যামে বাংলাদেশের প্রার্থিতা অনুমোদিত হয়। বঙ্গবন্ধু ৬ অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি মিসর ও সিরিয়ায় এক লাখ পাউন্ড চা প্রেরণের নির্দেশ দেন। আরব সমস্যায় ন্যাম সদস্যদের সমর্থন আদায়ে টিটো এবং বুমেদিনের উদ্যোগকে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু মিসর ও সিরিয়ায় চিকিৎসকদল প্রেরণ করেন।
১৯৭৪ সালের শুরুতেই চার দিনের এক সফরে বাংলাদেশে আসেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নরম্যান এরিক কার্ক। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটো ২৯ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। ফেব্রুয়ারিতে সফরে আসেন ওআইসি মহাসচিব। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরের দিন বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন। মার্চ মাসে বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মার্চ মাসে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মস্কো যান। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউ নে উইন। ১২ মে পাঁচ দিনের সফরে বঙ্গবন্ধু ভারত যান। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেংঘর ২৬-২৯ মে বাংলাদেশ সফর করেন। ১ জুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ১৫ জুন পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা আসেন। ওই মাসেই বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগুয়েন হু থু ঢাকায় এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন।
১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণের জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। ১ অক্টোবর তিনি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু ইরাক সফরে যান। ওই মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ঢাকা সফরে আসেন। বঙ্গবন্ধু ৫ নভেম্বর মিসর ও ১০ নভেম্বর কুয়েত সফরে যান। একই মাসে পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসেন। ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাজা ঢাকা সফরে আসেন। ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সফরে আসেন ভুটানের রাজা এবং এফএও-এর মহাপরিচালক।
১৯ জুলাই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আর্চবিশপ মাকারিয়সের নেতৃত্বাধীন সাইপ্রাস সরকারকে উত্খাতের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম অংশগ্রহণ করেই জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের দাবি জানায়। বাংলাদেশ আগস্ট মাসে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়। নভেম্বরে জাপান ও বাংলাদেশ যমুনা নদীর ওপর একটি তিন মাইল দীর্ঘ সেতু নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করে। ১৯ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে নামিবিয়া বিষয়ক কমিশনে মনোনয়ন দেয়।
১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরে আসেন জাপানের যুবরাজ আকিহিতো। একই মাসে নেপালের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপাল যায়। মার্চে ঢাকায় আসেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর প্রেসিডেন্ট। দুই দিনের সফরে ১৪ মার্চ ঢাকায় আসেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ। ওই মাসে সিডার প্রেসিডেন্টও ঢাকা সফর করেন। বঙ্গবন্ধু ২৭ এপ্রিল জ্যামাইকা যান কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। বাংলাদেশ ১৯ মে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এবং ২২ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য পদ লাভ করে। ২৩ জুন বাংলাদেশ বিশ্ব খাদ্য পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়।
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অনেক দেশ ও সংস্থা যেমন—সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ডাব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর প্রভৃতি বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে।
বাংলাদেশ যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে দেশটিকে করা হলো পিতৃহীন। সারা বিশ্বের মানুষ হলো স্তম্ভিত, উত্কণ্ঠিত। কয়েকজন ছাড়া বিশ্বনেতারা ধিক্কার জানালেন। কোটি কোটি বাঙালি অসহায়ের মতো নীরবে অশ্রু ঝরাল। চার বছরের সন্তানটিকে তুলে দেওয়া হলো বিশ্বাসঘাতকদের হাতে। লাখো শহীদের রক্তে গড়া দেশটিতে শুরু হয়ে গেল অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসা মানুষের দাপাদাপি। তাই তো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসা অবধি ঘুরেফিরে সামরিক ব্যক্তিরাই দেশ চালায়।
আমরা জানি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকতেই সৌদি আরব, সুদান, ওমান ও চীন ছাড়া বিশ্বের সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এর চেয়ে আর কি হতে পারে? আর এই সাফল্যের পেছনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা যে দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের নেতৃত্বে থাকেন সে দেশের পক্ষেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত লাভ করা বাংলাদেশের সাফল্য বা অর্জন বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর সফলতার কাছে পরবর্তী অর্জন খুব সামান্যই মনে হয়।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব