তোফায়েল আহমেদ
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমি আর মনি ভাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেই। রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী জিরো আওয়ারে শুরু করে বাঙালি নিধনে গণহত্যা। যা অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিকে সশস্ত্র পন্থায় নিশ্চিহ্ন করতেই এই গণহত্যা। চারদিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে তখন বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করো। আমার জন্য ভেবো না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ বর্বর পাকিস্তান বাহিনী বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি।
মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই সারাদেশসহ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালে জন্য কারফিউ জারি করা হয়। এ অবস্থায় রাতে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সকালে ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে সারাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা…। …কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে, এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।’ ২৭ মার্চ যখন ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়, তখন আমি আর মনি ভাই গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানিগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় প্রচারিত এম এ হান্নান সাহেবের ভাষণ শুনি, ‘কে বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।’ সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান সাহেব এবং অন্যান্য নেতা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভ‚মিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ এরপর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণা আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই দেয়ার পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল মূলত ৬ দফা দেয়ার মধ্য দিয়েই। ৬ দফাই ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ ৬ দফাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ৬ দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতীজ্ঞাবোধ তাঁকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আর আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ১৯৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ৬ দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে ১১ দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারাদেশে গণজোয়ার তৈরি হয় এবং বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণি আমাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পায়। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ১৯৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বলেছিলাম, ‘পূর্ববাংলার মানুষ কোনোদিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারো পূর্ববাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’ পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোনো উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দেইনি। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজবন্দির মুক্তির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি যে দিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয় সে দিন তিনি বলেছিলেন, ‘সংখ্যা সাম্য নয়, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব চাই, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার চাই আর সার্বভৌম পার্লামেন্ট চাই।’ গোলটেবিল বৈঠকের পর যখন মার্চের ২৫ তারিখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নেন, তখন তিনি বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উত্থাপিত দাবিসমূহ মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করেন। এবং ১৯৭০-এর ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২ অনুযায়ী লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার বা সংক্ষেপে এলএফও জারি করেন। সর্বমোট ৪৮টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এই এলএফওতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সে জন্য এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭নং দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। ২৫নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, ‘শাসনতন্ত্রের প্রমাণীকরণ’। যাতে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় পরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র বিল, প্রমাণীকরণের জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট উপস্থাপিত হবে। এই পর্বে প্রমাণীকরণে প্রত্যাখ্যাত হলে জাতীয় পরিষদের অবস্থান লুপ্ত হবে।’ আর ২৭নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, ‘আদেশের সংশোধন এবং ব্যাখ্যা, ইত্যাদি’, এর ক-ধারায় ছিল, ‘এই আদেশের কোনো আইনের ধারা সম্পর্কে কোনো ধারণা, কোনো ব্যাখ্যা বা কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চ‚ড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না’ এবং একই অনুচ্ছেদের খ-ধারায় ছিল, ‘জাতীয় পরিষদ নয় বরং রাষ্ট্রপতিই এই আদেশের সংশোধনের ক্ষেত্রে চ‚ড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।’ এলএফওতে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস।
বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির বিপরীতে ভুট্টো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেন। আর বঙ্গবন্ধু জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করেন। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সে দিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ সে দিন বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় নির্বাচনী ফলাফলে আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ‘আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কাছে দেনা হয়তো আবারো রক্তেই পরিশোধ করতে হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য চক্রান্ত চলছে, এর বিরুদ্ধে আসন্ন সংগ্রামের জন্য সবাই প্রস্তুত থাকবেন।’ চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু সদা-সচেতন ছিলেন। এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭১-এর ১১ জানুয়ারি ঢাকা এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি দুদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুদফা আলোচনায় মিলিত হন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের ভাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।’ ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীল নকশা প্রণীত হয়।
১৯৭১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মনসুর আলী নেতা, জাতীয় পরিষদে উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও সর্বজনাব ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান ও আমীর-উল ইসলাম যথাক্রমে চিফ হুইপ ও অপর দুজন হুইপ নির্বাচিত হন। এরপর আসে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৭১-এর শহীদ দিবস ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিন মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই বাংলার স্বাধিকার, বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেব। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করব না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দেব না।’ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চ‚ড়ান্ত করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি করাচি প্রেসিডেন্ট হাউসে পুনরায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া শলাপরামর্শ শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের আহবান জানান। একইদিন লাহোরে এক জনসভায় ভুট্টো হুমকি দেন, ‘তার দলের কোনো সদস্য যদি পরিষদ অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলের সদস্যরা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার দল খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত সব কিছু অচল করে দেবে।’ এ ছাড়াও জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি যেসব সদস্য অধিবেশনে যোগদানের জন্য ইতোমধ্যেই ঢাকা গিয়েছেন তারা ফিরে গেলেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ারও হুমকি দেন। ভুট্টোর এসব উত্তেজক হঠকারী বক্তৃতা-বিবৃতির একটিই উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হচ্ছে যে কোনো মূল্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা। ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য অবশেষে ১৯৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করেন। জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্য জনসাধারণে প্রকাশিত হয়। এরকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু আগেই আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন এবং তাঁর অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে জনাসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এ দিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল গগনচুম্বী। তিনি সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে আহবান রেখেছিলেন এই নির্বাচনকে রেফারেন্ডামে পরিণত করতে। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে গণভোটে পরিণত করেছিল। বাংলার মানুষের অধিকার বিসর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনোই ভাবেননি তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় সে কথা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ তিনি তো ১৯৭১-এর ১৭ মার্চ তাঁর ৫২তম জন্মদিনে পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমার জীবন আমি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’