‘তোমার ডাকে যুদ্ধে গেলাম, অস্ত্র নিলাম-জীবন দিলাম’


ফারুক ওয়াহিদ:
তুমি বাংলার বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত নির্যাতিত জনগণের মুক্তির দূত হিসাবে আবির্ভূত হয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছিলে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য- তুমি হলে বাঙালির মুকুটমণি, শতাব্দীর মহাপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি- বাংলার কথা বাঙালির মুক্তির কথা বলতে গিয়ে তোমার জীবন-যৌবনের মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো কেটেছে পাকিস্তানি স্বৈরাচার সামরিক শাসকদের কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।

একদিন “তোমার ডাকে যুদ্ধে গেলাম/ অস্ত্র নিলাম-জীবন দিলাম”- কিন্তু আজ তোমাকে দেশেতো বটেই এমনকি বিদেশের মাটিতেও বিশেষ করে লন্ডনে পাকিস্তানি বাঙালিরা চরমভাবে অপমানিত করছে- আমরা ‘একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা’রা তোমার নামে শপথ নিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেও আজ আমরা কিছুই করতে পারছি না- তোমার অপমানের জবাব দিতে পারছি না- শুধু অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে- অন্তরে রক্তক্ষরণের কষ্ট কাউকে বুঝানো যায় না বলা যায় না।
 
হ্যাঁ, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর কথাই বলছি। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে তোমার সঙ্গে বৈঠকের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তুমি ঠিক এভাবেই ‘জয়বাংলা’-র ব্যাখ্যা দিয়েছিলে- “শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও কলেমা পাঠের সঙ্গে ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করব আমি” অথচ আজ জয়বাংলা নির্বাসিত- এখনো তোমার ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানকে জাতীয় শ্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি- আদৌ হবে কিনা জানিনা এবং একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা দেখে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। সারা পৃথিবী কাঁপানো ঝাঁঝালো শ্লোগান ‘জয়বাংলা’ শুধু একটি এবং একটি শ্লোগানেই দেহে শিহরণ জাগতো, হৃদয় আন্দোলিত হতো- অথচ মুক্তিযুদ্ধের এই হৃদয়গ্রাহী শ্রুতিমধুর তোমার ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের বদলে এখন বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’, ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক’ এই জাতীয় পাকিস্তানি ধাঁচের শ্লোগান- এখানেও আমাদের ‘একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা’দের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

অগ্নিঝরা ৭ মার্চ ’৭১ রবিবার রক্তঝরা অগ্নিঝরা রোদন ভরা বসন্তের উত্তপ্ত ফাল্গুনের অপরূপ অপরাহ্ণে ঢাকার রমনার সবুজ প্রান্তর রেসকোর্স ময়দানের জনমহাসমুদ্রে এদিন তুমি সারা পৃথিবী কাঁপানো ভাষণের টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলে, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো তোমার বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে তুমি উচ্চারণ করেছিলে, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।” এই ঐতিহাসিক ভাষণই তোমার নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যত ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। শত্রুর মোকাবেলায় তুমি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দিয়েছিলে, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।” তোমার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। স্মৃতিময় ঐতিহাসিক সেই দিনে উপস্থিত থেকে ঘটনার ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হিসেবে এখনো আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে! তোমার বজ্রকণ্ঠের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য(ওয়ার্ল্ডস ডক্যুমেন্টরি হেরিটেজ) হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে- ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল গৌরবের।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় বলেছেন, “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালি করে- মানুষ করনি।।” -কিন্তু তুমি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেই রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি কবিগুরুর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার সেই দু’টি  লাইন উচ্চারণ করে অত্যন্ত আবেগময় মর্মস্পর্শী ভাষণে কবিগুরুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলে, “আমার বাঙালি আজ মানুষ।” এ কথা বলে আবেগাপ্লুত অশ্রুসিক্ত হয়ে শিশুর মতো তুমি কাঁদলে এবং রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতাকে কাঁদালে- কাঁদালে সমগ্র বাংলার কোটি কোটি বাঙালিকে। কিন্তু আমি বলবো বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথের কথাই ঠিক রয়েছে- তোমার কথাই আবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে- যদি তোমার কথা অনুযায়ী বাঙালি সেদিন থেকে মানুষ হতো তাহলে তোমাকে মারতে পারতো না- যদি তোমার কথা অনুযায়ী বাঙালি মানুষ হতো তাহলে তোমাকে বিদেশের মাটিতে তথা লন্ডনে এই ২০১৮-তে এসে এভাবে অপমানিত করতে পারতো না।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে(ন্যাম) যোগ দিতে গিয়ে তোমার বিশালতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তোমারই অন্তরঙ্গ বন্ধু কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নির্ভীকতা হিমালয়ের মতো। এভাবেই তার মাধ্যমে আমি হিমালয়কে দেখেছি।” তুমি ছিলে বিশ্বনেতা- বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে তুমি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে তুলে ধরেছিলে- কিন্তু তোমার এই অন্তরঙ্গ বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ট্রো তোমাকে একটি ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন- তারপরও তুমি সতর্ক হলে না- কারন তুমিতো প্রকাশ্যে ঘোষণাই দিয়েছেলে- “আমার বাঙালি আজ মানুষ।”


অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, “পৃথিবীতে খুব কম দেশ আছে, যে দাবি করতে পারবে একটি দেশ এবং একটি মানুষ সমার্থক। বাংলাদেশের মানুষেরা সেই দাবি করতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না।” অথচ তারপরেও বাংলাদেশের মানুষ তোমাকে লন্ডনে অপমানিত করলো- যদিও তারা পাকিস্তানি বাঙালি।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনাকে এবং তোমার নাম নিশানা পর্যন্ত চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল- কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।

মুঘল সম্রাট আকবর-কে ‘আকবর দি গ্রেট’ বলা হয় এবং গ্রিক বীর বিশ্ববিজয়ী আলেকজেন্ডার-কে ‘আলেকজেন্ডার দি গ্রেট’ বলা হয়। কিন্তু বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে কেন শুধু বঙ্গবন্ধু বলা হয়? স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু দি গ্রেট’ বলার সময় হয়নি? বঙ্গবন্ধুকে শুধু বঙ্গবন্ধু কে কে বললো বা না বললো তাতে আমার কিছু আসে যায় না- যার ডাকে যুদ্ধে গেলাম অস্ত্র নিলাম- যিনি আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয় সঙ্গীত উপহার দিয়েছেন- মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে বলে যাব এবং বলেই যাব তিনি হলেন বাঙালি জাতির পিতা শতাব্দীর মহাপুরুষ ‘বঙ্গবন্ধু দি গ্রেট’।


মুক্তিযুদ্ধ জয়ের এতো বছরে মেঘনা-তিতাস-পদ্মা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। আজ সময় এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ছিল সুখী অভাবমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা- তার কতটুকু আমরা অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন- কিন্ত আমরা কি সেটা অনুধাবন করতে পেরেছি? ১৯৭৫-এর পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বাঙালি জাতিকে ভিতরে ভিতরে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধেরে ইতিহাসকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করছে। মিথ্যা বলা হয়েছে, মিথ্যার অভিনয় করা হয়েছে- এমন কি রূপকথার প্রবাদ পুরুষ বাঙালির অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা পর্য্যন্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে- তাই অন্নদাশঙ্কর রায়-এর কবিতার ভাষায় বলতে হয়-

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান

তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান”

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা [২নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া]

SUMMARY

2048-1.jpg