বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম। বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। জনগণ,দেশ তথা নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্ম করতে পেরেছিলেন অবলীলায়া। আরও স্পষ্ট করে যদি বলা হয়- দেশ জনস্বার্থের কাছে তিনি নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। নিজের স্বার্থ বলতে ঠিক তেমন কিছু আসে না, আর এ কারণেই বোধহয় কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আর এক নাম রাখেন এক অর্থে বঙ্গবন্ধুই একটা পর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস।
তাঁর ভাবনায় বহুবার বহুরকম মুটোবার্তা প্রকাশিত হলেও সর্বোপরি তা ছিলো দেশকে ঘিরে। যেমন- ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন- এসব স্থানে শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়, বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করে নেয় নিজেদের নেতা হিসেবে।
তার কর্ম ও সাধনা, চিন্তা ও ধ্যানে সর্বদা ক্রিয়াশীল থেকে বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ।
যদি আমরা একটু পেছন থেক ভাবি/দেখি-
কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি পালন করেন নেতৃত্বের ভূমিকা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তি-উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ্রকণ্ঠ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের তার ভাষণ ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে স্বাধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। একটি ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, সবাইকে মিলিয়েছে একবিন্দুতে- এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাস বিরল।
কারাগারে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, সেখানেও দেশের মাটির কথা তিনি চরম বিপদের মুখেও উচ্চারণ করেন নির্ভীকচিত্তেই। আর তাই নির্দ্বিধায় কবি- অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই শব্দগুচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঙ্গবন্ধু সচেতনভাবে এখানে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেছেন। যুদ্ধাপরাধের এই বিচার প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক এক ডিসকোর্সের সামনে আজ বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বক্তব্য আরও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে।
হেমিলনের বংশীবাদকের মতো বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছেন। তিনি হলেন রাজনীতির কবি- Poet of politics। রাজনীতিকে তিনি সৃষ্টিশীল চেতনা দিয়ে নিজের হাতে আকার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বুলগেরীয় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নািসদের হাতে নিহত হন উইলিয়াম টমসন নামে এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন কবি। মৃত্যুর পর তার পকেটে নোট বইয়ে কিছু কবিতা পাওয়া যায়। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন—We who know the most of living can give it too- ‘অর্থাত্ আমরা যারা জীবনকে নানাভাবে সাজাতে জানি তারাই জীবনকে দান করে যেতে সক্ষম।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তেমনই একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে নানাভাবে সাজিয়েছিলেন এবং হাসিমুখে জীবনটা বাঙালি জাতিকে দানও করে গেছেন। আমাদের চারপাশে তাকালে দেখব কেউ অর্থের পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ সাফল্যের পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে ছুটে হয়রান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসবের কোনোটার পেছনে ছুটেননি। তিনি ছুটেছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের পেছনে, বাঙালি জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের পেছনে। তার সকল চিন্তা ও কর্মের মূলে ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির উপায় উদ্ভাবন। তাই তিনি বাঙালি জাতির জনক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
এবার একটু আসি.. বাংলাদেশ তথা বর্তমান প্রেক্ষাপটে… তখনো তার স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ এখন.. যেভাবে:-
বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। তাঁরা সফলতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছেন। দেশে পাঠাচ্ছেন বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমানে শীর্ষ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, “আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়, শিক্ষা পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।” প্রকৃতপক্ষে মানুষ যা ভাবে তাই তার কথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই কথাগুলোর মধ্যে দেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর মায়া-মমতা এবং তাদের উন্নত ভবিষ্যতের চিন্তা গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি ও কৃষক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। স্বপ্নের বাংলাদেশে কিষান-কিষানীরা হবেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত। বীজ বপন হতে শুরু করে ফসলের পরিচর্চা, জলসেচ, ফসল সংরক্ষণ, বিপণন প্রভৃতি বিষয়ে একেকজন কৃষক হবেন একেকজন বিশেষজ্ঞ। অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি আবহাওয়া, পরিবেশবান্ধব বালাই দমন, পরিবেশবান্ধব উর্বরতা প্রভৃতি থাকবে তাদের নখদর্পণে। কৃষকরা হবেন সোনার বাংলার গর্বের ধন। সুশিক্ষিত, নম্র, ভদ্র, সচেতন ও রুচিবান কৃষকরা হবেন সোনার বাংলার গৌরব। আর এ সবই ছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নয় বাস্তবরূপ দেওয়ার অদমনীয়তা।
স্বপ্নের দেশের সবাই হবেন সুশিক্ষিত। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা উন্নতমানের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে সুশৃঙ্খলভাবে। স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেনো বাগান ও সবুজের সমারোহে সুসজ্জিত একেকটি উদ্যান; পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি পরিবেশ যেনো হাতছানি দেয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেনো শান্তির আলয়, তা নাহলে কি প্রকৃত শিক্ষা সম্ভব? সোনার বাংলায় জীবনমুখী শিক্ষাসহ শেখানো হয় তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম ও নৈতিকতা। তাই অন্যায়, অত্যাচার, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি থাকবে না সোনার বাংলায়। এখানে সবাই হবেন সুশিক্ষিত, শিক্ষার হার হবে শতভাগ।
অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি সোনার বাংলার অধিবাসীরা হবেন সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকবে বিভিন্ন ধরনের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানে থাকবেন সুশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বৃদ্ধ, অসুস্থ এবং মা ও শিশুদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়া হবে। আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামে সমৃদ্ধ সোনার বাংলার মানুষকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। বরং বিদেশীরা চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আসবেন স্বপ্নের সোনার বাংলায়, এই বাংলাদেশে।
দেশের গ্রাম-শহর-নগর সবখানে মোবাইল ফোন ও মোবাইল ইন্টারনেট হবে যোগাযোগের মাধ্যম। স্বপ্নের দেশে প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে থাকবে ব্র্যডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। একসময় এসব সুযোগ-সুবিধার জন্য বিভিন্ন ধরনের তথ্যকেন্দ্রে যেতে হলেও সোনার বাংলায় এর প্রয়োজন হবে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাড়িতে বসে এখন তথ্য আহরণ করেন সবাই। বিভিন্ন ধরনের সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সংযোগ রাখেন স্বপ্নের সোনার বাংলার অধিবাসীরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হবে ২০২১ সালে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হবে ২০২১ সালে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন কি স্বপ্নই থাকবে, না বাস্তব রূপ লাভ করবে? তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মাঝারি আয়ের দেশে এবং আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য স্থির করেছে বাংলাদেশ সরকার। এজন্য সরকার জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ গ্রহণ করেছে। এই নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘রূপকল্প ২০২১ : ডিজিটাল বাংলাদেশ’।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বপ্ন দেখেছিলেন তখনো
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই জন্যই পুরো জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই তিনি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তাঁর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তৃতা, সাক্ষাতকার এবং রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় তিনি সর্বস্তরে বাংলা চালুর এই পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমিতে শহীদ দিবস (ভাষা শহীদ দিবস) উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপি অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার বাংলা একাডেমি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি কোন ছুটির দিন ছিলো না। তবুও সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে প্রখ্যাত লেখক, কবি, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিলো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। বঙ্গবন্ধু এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। বাংলা একাডেমির সেসময়কার চেয়ারম্যান প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুরতজা আলীর সভাপতিত্বে সেদিন স্বাগত বক্তব্য দেন বিশিষ্ট লেখক ও বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক কবির চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য অনেক বক্তৃতার মতই সেদিনের বক্তৃতাও দেশের প্রধান প্রধান বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের দেয়া এসব বক্তৃতা থেকে নির্বাচিত বক্তৃতা নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। মুক্তধারা প্রকাশন ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ নামে এই সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করে।
ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় আসলে শুরুতেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা হবে। তিনি সেদিন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য কীভাবে বাংলা পরিভাষা তৈরি করা হবে সে ব্যাপারেও পরামর্শ দেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সরকারি অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তা সত্ত্বেও এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাভাষা খুব কম ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় বই ও পরিভাষার অভাবের অজুহাতে এখন উচ্চ আদালতে দাপ্তরিক কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা ‘তখনই’ শুরু করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষার অপেক্ষা করবো না। তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। তিনি আরো বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বলেন, ভাষার গতি নদীরধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। ছাড়াও লেখক, কবি এবং নাট্যকারদের মুক্তমনে লেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যই সাহিত্য। এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন। দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। তনি বলেন, আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।
@সর্বোপরিঃ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম চরণ আমাদের মনে কী উপলব্ধি নিয়ে আসে? জাতীয় সঙ্গীতের পরবর্তী চরণসমূহে তার আভাস পাওয়া যায়। কবি মায়া-মমতায় ভরা এমন এক দেশের কথা লিখেছেন, যে দেশের ভাষা, দৃশ্য, পরিবেশ, আকাশ, বাতাস প্রভৃতি মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে। অভাব-অনটন নেই এমন এক শান্তির দেশ কবির কাব্যে। অভাব-অনটন, অন্যায়-অত্যাচার নেই এমন শান্তির দেশ কি আমরা পেয়েছি? কবি লিখিছেন-‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি’। আমরা বাংলার মলিন মুখ দেখতে চাই না, আমরা সোনার বাংলা চাই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি আমাদেরকে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এমন এক শান্তিময় দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে থাকবে না কোনো অভাব-অনটন, থাকবে না কোনো অন্যায়-অবিচার। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আমরা কি স্বপ্নের সোনার বাংলা পেয়েছি? সোনার বাংলা অর্জনের জন্য আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনের জন্য আমাদের আরও সংগ্রাম করতে হবে, আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে এবং আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু একসূত্রে গাঁথা। এরা কেউ কারো থেকে আলাদা নয়। বঙ্গবন্ধু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত হয়ে বাঙালির মুক্তির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বাঙালিকে, বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। কিন্ত সেই ভালোবাসাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি যখন দেশকে সবদিক থেকে উন্নত করার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনি একদল বিশ্বাসঘাতক তাকে হত্যা করে সপরিবারে। দিল্লীর প্রার্থনা সভায় মহাত্মা গান্ধী যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন বার্নার্ড শ নিজস্ব ভঙ্গিতে মন্তব্য করেছিলেন— It is too dangerous to be too good. বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন।
“মুজিব বলেই জানে “
… / মমিনুল মমিন
এসেছিলে তুমি বাংলার আকাশে রক্তিমা আভায় রক্তিম সূর্য হয়ে, ভূবন দ্রষ্টায়ে গেছো চলে অকালে
দূরদেশে আর আসবেনা বলে।
তোমার স্বপন জুড়ে ছিল কত আশা-
দেখিবে ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ্যে কোটি বাঙালী পিঁপীড়ার ন্যায় দলবলসমেতে এগোয়ে ছড়াবে-
তোমার চেতনঊষা প্রসারিত করে পৌঁছাবে আলোর দিগন্তে দেখিতে বাংলার সুদিন।
সানন্দে- শঙ্খচিল উড়বে স্বাধীনদলে,
বুনোহাঁস বেড়াবে ঝিলের জলে।
তোমার প্রতিচ্ছবিতে ভাসে আজ অনেকেই-
কেবলি তারা আজ আত্মসুখে মশগুল,
তোমার চেতনাত্মক নীতির নামে করে
প্রহসন, ঠকবাজ মুখোশধারী তারা।
হে নীতির নায়ক, হে সাম্যের গায়ক!
তুমি আবারো আসো এ বাংলায় বহুবার,
মুজিব নামে নয়! তাতে কি?
ভিন্ন কোন নাম নিয়ে,
তোমার রীতিনীতির নির্যাস যেন থাকুক
অবিকল সে প্রাণে।
তাকেও যেন কালে কালে কোটি বাঙালী
মুজিব বলেই জানে।।