জননায়কের আবির্ভাব ও তিরোধান : আনিসুজ্জামান

জননায়কের আবির্ভাব ও তিরোধান : আনিসুজ্জামান

সারা বাংলাদেশে এবারের ১৭ মার্চ দেশটির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন হয়েছে। ফরিদপুর জেলার (এখনকার গোপালগঞ্জ জেলার) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন একজন জোতদার ও স্থানীয় আদালতের নাজির। সশস্ত্র বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের কথা শুনে এবং ঘরের কাছে (বাঘা যতীনের সহকর্মী) মাদারীপুরের পূর্ণচন্দ্র দাসের বিপ্লবী প্রয়াসের কথা জেনে, মুজিব আকৃষ্ট হন স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি। দুটি ঘটনা তাকে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয় বলে মনে হয়। তাঁর সহপাঠী ও নিকট প্রতিবেশী ননীগোপাল দাস একদিন তাঁর (কাকার) বাড়িতে মুজিবকে নিয়ে যান এবং থাকার ঘরে বসান। পরে ননী কাঁদো কাঁদো হয়ে মুজিবকে বলেন, তাঁদের বাড়িতে আর না-যেতে। কেননা, মুজিবকে ঘরে নিয়ে বসানোর জন্য তাঁর কাকিমা (যিনি মুজিবকে খুব ভালোবাসতেন) ননীকে খুব বকেছেন এবং নিজে ঘর ধুয়ে ফেলেছেন, ননীকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছেন। পরে মুজিব লেখেন, এই ঘটনা ‘আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই।’
দ্বিতীয় ঘটনা ১৯৩৮ সালের। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফর উপলক্ষে একটি জনসভা ও প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। স্কুলের ছাত্র মুজিব হন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের নির্দেশে বর্ণহিন্দু তরুণরা শেষমুহূর্তে এই আয়োজন থেকে সরে দাঁড়ায় (তফসিলি ছেলেরা অবশ্য রয়ে যায়। কারণ, মন্ত্রী মুকুন্দবিহারী মল্লিকও আসছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে)। পরে মুজিব লিখেছেন, ‘আমি এ-খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান-বাজনা, খেলাধুলো, বেড়ান সব চলত।’ এই সংবর্ধনা নিয়ে সাম্পদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা সত্তে¡ও সৌভাগ্যবশত শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সমাধা হয়। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের জন্য পরে মুজিব অনেক দুঃখ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অন্তর্নিহিত কারণ যেমন করে রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসু অনুধাবন করেছিলেন, আর কেউ তেমনটা করেননি।
সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সেবারের সামান্য পরিচয়ের সূত্রে শেখ মুজিব ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ফিরে এসে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক হন নিজে, মুসলিম লীগের সম্পাদক অন্য কেউ হলেও মূল কাজ তাঁকেই করতে হতো।
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন, থাকেন বেকার হোস্টেলে, সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। ততদিনে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে। সুতরাং, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। পাকিস্তান বলতে তিনি বোঝেন দুটি রাষ্ট্র একটি পুবে, অন্যটি পশ্চিমে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে তখন দু’টি উপদল ছিল একটি মোহাম্মদ আকরম খাঁ-খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে, অপরটি সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন। শেষোক্ত উপদলটি পরিগণিত হতো প্রগতিপন্থি হিসেবে, কেননা এ দলের সদস্যরা চাইতেন মুসলিম লীগকে ‘জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের’ প্রভাবমুক্ত করে জনগণের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে আর চাইতেন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে। মুজিব এই শেষোক্ত উপদলভুক্ত হন এবং আবুল হাশিমের প্রেরণায় হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের সর্বক্ষণের কর্মী।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ে শেখ মুজিব সারা দিন লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন, রাতে কখনও হোস্টেলে ফিরেছেন, কখনও মুসলিম লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। কাছাকাছি সময়ে তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরক্ত হয়ে ওঠেন, তবে জাপানিরা ভারতবর্ষ দখল করলে এ-দেশকে স্বাধীনতা দেবে কি না, সে-বিষয়ে সন্দেহমুক্ত হতে পারেননি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কালে মুসলমান ছাত্রীদের উদ্ধার করা, আহতদের শুশ্রষার ব্যবস্থা করা, এলাকা পাহারা দেয়া ইত্যাদি নানারকম কাজ করেছেন। মুসলমানদের যেমন উদ্ধার করেছেন, তেমনই হিন্দুদের উদ্ধার করেও নিরাপদ এলাকায় পাঠিয়েছেন। ইসলামিয়া কলেজের তখনকার শিক্ষক অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত পরে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে, সে-সময়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র তাঁকে বিপদসংকুল এলাকা এবং নিরাপদ অঞ্চলের সীমা পর্যন্ত পাহারা দিয়ে আনা-নেয়া করেছে।
১৯৪৭ সালের এপ্রিলে জিন্নাহ দিল্লিতে ডাকলেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের লীগদলীয় সদস্যদের সম্মেলন। সেখানে তাঁর নির্দেশে ‘লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক রদবদল করা হলো।’ আগে যেখানে ‘স্টেটস’ ছিল, সেটা করা হলো ‘স্টেট’, আর এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন সোহরাওয়ার্দী। আবুল হাশিম ‘আর সামান্য কয়েকজন’ সংশোধনীর বিরোধিতা করলেন, কিন্তু প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। মুজিব খুব হতাশ হলেন, তবে এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর কখনও কথা হয়েছিল কি না, তা জানা যায় না। অনতিবিলম্বে মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা এলো ভারতের সঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলাও বিভক্ত হবে। মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায় অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলা গঠনের চেষ্টা করলেন। সে-প্রয়াস ব্যর্থ হলো। মুজিব আর-একবার হতাশ হলেন।
তারপরও পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি তিনি কিছুদিন আস্থা রেখেছিলেন, কিন্তু তার কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে সরকার-পৃষ্ঠপোষিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিপরীতপক্ষে সমমনা ছাত্রনেতা-কর্মী নিয়ে তিনি গঠন করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় প্রথমবার আন্দোলন হয় এবং মুজিব গ্রেপ্তার হন। চারদিন পর তিনি মুক্তি পান, কিন্তু ১৯৪৯ সালে আবার গ্রেপ্তার হন এবারে মাস ছয়েকের জন্য। তিনি কারাগারে থাকতেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হয় সরকারবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ আর মুজিবকে নির্বাচিত করা হয় তার একজন যুগ্ম সম্পাদক। মুজিব মুক্ত হন জুলাই মাসে, আবার গ্রেপ্তার হন ডিসেম্বরে এবারে আড়াই বছরের কারাবাস। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন যখন সমাগত, তখন তিনি কারাবন্দি হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকেই এই আন্দোলনের নেতাদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। অনশনরত মুজিবের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর কতবার যে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তা বলা শক্ত।
১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভার গুণে এই সংগঠন জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত স্থান করে নেয়, মুজিবও কর্মী থেকে নেতায় উন্নীত হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের আগে মুজিবের সায় না থাকলেও বিরোধী দলগুলোর একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং নির্বাচনে তা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় মুজিব স্থান পান বটে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। ১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই গণপরিষদ যখন পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচনা করে, তখন তিনি প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা রাখার পক্ষে, দেশের নামে ইসলামি প্রজাতন্ত্র যুক্ত করার বিপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার জন্য জোরাল বক্তব্য দেন। এ-সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে যে মুসলিম শব্দটি বর্জিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে যে-প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার পেছনে তাঁর সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল। ১৯৫৬ সালে তিনি পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হন, তবে দলীয় কাজে অধিকতর মনোযোগ দেয়ার ইচ্ছে থেকে অল্পকালের মধ্যে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তবে পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতান্তরের কারণে ১৯৫৭ সালে যখন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন, তখন মুজিব আওয়ামী লীগেই রয়ে যান। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়, ১৯৬২ সালে তা প্রত্যাহার করা হলেও আইয়ুব খানের কর্তৃত্ববাদী শাসন অব্যাহত থাকে। মুজিব কয়েক বছর কারাগারে ও স্বগৃহে অন্তরীণ থাকেন। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তিনি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-প্রতিরোধে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে তিনি ছ’দফা দাবিনামা পেশ করেন। প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন ছিল এর মূলকথা। তিনি বলেন, এই দাবিনামা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত। সরকার বলে, এ হলো পাকিস্তানের অখণ্ডতা-বিনষ্টির প্রয়াস। পূর্ব বাংলার সর্বত্র জনসভা করে ছ’দফার পক্ষে মুজিব জনমত সৃষ্টিতে সমর্থ হন। উত্তরে সরকার তাঁকে বারংবার গ্রেপ্তার করে। ততদিনে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন। পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দি অবস্থাতেই ১৯৬৮ সালে তাঁকে প্রধান আসামি করে এবং আরো ৩৪ জন সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয় বিশেষ আদালতে। এর প্রতিক্রিয়া হয় সরকারের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীত। পূর্ব বাংলায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। তাঁকে জনগণ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে পদত্যাগ করতে হয়।
নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করেন, তবে ‘একজন এক ভোট’-এর ভিত্তিতে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন ১৯৭০ সালের শেষে। তার আগে আওয়ামী লীগের ঘোষণায় প্রথমবারের মতো বলা হয় যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তবে শেখ মুজিব এ নির্বাচনকে অভিহিত করেছিলেন ছ’দফার পক্ষে গণভোট বলে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং ছ’দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা-হস্তান্তরে অনিচ্ছুক, তা স্পষ্ট হয়ে গেলে মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সে আন্দোলনের সাফল্য সারা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। অধিকাংশ দেশবাসী, বিশেষত তরুণ সমাজ, চাইছিল বঙ্গবন্ধু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ৭ মার্চের জনসভায় যে-ভাষণ দেন, তা এখন বিশ্ব-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বস্তুত এই ভাষণের সময়টাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সেরা সময়। তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি বটে, কিন্তু বক্তৃতার শেষে সুস্পষ্টই বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ক্ষমতাসীন চক্র আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে এবং ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ইতিহাসের অতি নৃশংস গণহত্যার সূচনা করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন, কিন্তু তাঁর স্বাধীনতা-ঘোষণার দুটি ইংরেজি ভাষ্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সে-যুদ্ধ তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছিল। পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিচার হয় এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। বন্দিশালায় তাঁকে দেখিয়েই তাঁর সমাধি খনন করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষকে তিনি একটিই প্রার্থনা জানান মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ যেন বাংলাদেশে সমাধিস্থ করা হয়।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে শেখ মুজিব প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তার দু’দিন পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং বাস্তুচ্যুত ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জাতি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান লাভ করে এবং পরের বছরের প্রথমদিকে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু সময়টা আর আগের মতো ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছিল, অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে গিয়ে মানুষের প্রকৃতিও বদলে গিয়েছিল। বৈরী আবহাওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত একদলীয় শাসন প্রবর্তিত হয়। গণতন্ত্রের, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্যে শেখ মুজিবের আজীবন সংগ্রামের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ ছিল না। তিনি অবশ্য বলেছিলেন, এটি সাময়িক অবস্থা। কিন্তু তার ফল কী হয়, তা দেখার আগেই ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে তিনি সপরিবার নিহত হন। এই প্রতিবিপ্লব অনেক রক্তক্ষয়, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির অনেক পরিবর্তন, মানুষের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয় অনেক সময় ধরে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে তাঁকে অপসারণ করা যায়নি।

SUMMARY

204-1.jpg