১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি তখনকার পাকিস্তান সরকার। প্রায় সাড়ে ৪৬ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ অমূল্য বিশ্বসম্পদ ও ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তা সংরক্ষণ করার এবং বিশ্বকে জানানোর দায়িত্ব নিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘মনে রাখবা—রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা’—১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর সেই মহাকাব্যিক দৃপ্ত উচ্চারণ আগে থেকে লেখা ছিল না। বরং তা ছিল মুক্তিকামী বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক এক তাৎক্ষণিক ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে গত বছর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ স্থান দিয়েছে ইউনেসকো। এ প্রসঙ্গে ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে লিখেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে
বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা।
ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে আরো লিখেছে, উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া জাতিরাষ্ট্রগুলো অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে ব্যর্থ হয়ে কিভাবে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনগণকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তার যথার্থ প্রামাণ্য দলিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ ছিল তাৎক্ষণিক, লেখা দেখে তিনি ভাষণ দেননি। তবে তাঁর ওই ভাষণ অডিও ও অডিও ভিজ্যুয়াল (এভি) সংস্করণে এখনো টিকে আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে—এমন দলিলগুলোকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। ডকুমেন্টগুলো সংরক্ষণ করা এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনের জানার ব্যবস্থা করাই এর উদ্দেশ্য। তালিকায় স্থান দেওয়ার আগে এর গুরুত্ব বিষয়ে ইউনেসকোকে সন্তুষ্ট হতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেওয়ার ফলে বিশ্ব এখন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এ দেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারবে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, সংরক্ষণের অভাবে বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, এমন নথি ও দলিলগুলোর গুরুত্ব যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে দুই দশক ধরে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে ইউনেসকো। কোনো নথি ও দলিল বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকা ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবে না সে বিষয়টি নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি। বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকেও ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করে। গত বছরের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর পরামর্শক কমিটি তার বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করে। এরপর ৩০ অক্টোবর ইউনেসকোর তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানান। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণই ইউনেসকোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া একমাত্র দলিল, যার কোনো লিখিত রূপ বা পাণ্ডুলিপি নেই।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইউনেসকোর কাছে তাদের আবেদনপত্রে ৭ই মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছিল, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এমন এক সময় তিনি ওই ভাষণ দিয়েছিলেন, যখন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা তাঁকে ক্ষমতা দিচ্ছিল না। ওই ভাষণে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।
আবেদনপত্রে আরো বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা গণহত্যা শুরু করলে বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। সেই রাতেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে টানা ৯ মাস তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রাখলেও তাঁর ওই ভাষণ বাঙালি তরুণদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিচেস দ্যাট’-এ স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার ব্যর্থতা কিভাবে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে, তার আদর্শ বর্ণনা রয়েছে ওই ভাষণে। বিশ্বজুড়ে যে দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে এবং নিজ ভূখণ্ডের সব নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আজও প্রাসঙ্গিক।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ :
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ । বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেদিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে গর্জে উঠেছিল জনসমুদ্র। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছিল লাখো মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে।
সেদিন বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিট ধরে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। ওই সময় সমগ্র উদ্যান মুখরিত হয়ে উঠেছিল লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা-আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে। স্বল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ভাষণে ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি।
বঙ্গবন্ধুর সেই উদ্দীপক ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতা ও গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা। এর পরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে ও পাড়া-মহল্লায় চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, একটি নতুন পতাকা।
ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করায় দিবসটি এবার নতুন মাত্রায় আরো বিস্তৃত পরিসরে পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন।