সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু


ড. আতিউর রহমান 

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে হাঁটছে। এরই মধ্যে নিজস্ব অর্র্থায়নে পদ্মা সেতু সোনার বাংলা গড়ার সুখস্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের এক অনন্য উপাদানে পরিণত হতে যাচ্ছে। ক্রমেই এই সেতু রূপান্তরিত হচ্ছে বিত্তহীন বাঙালির আত্মপ্রসাদের মাইলফলক হিসেবে। তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল। পথের ভোগান্তি দূর করতে সড়ক ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। নতুন নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বত্রিশ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ দিয়ে আট মাসেরও বেশি সময়ের আমদানি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এখন এই দেশটাকে সোনার বাংলায় সম্পূর্ণ উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা, কমবেশি ষোলো কোটি মানুষের আত্মসচেতন মনোভাব ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা অনুভব ও প্রকাশ করার আহŸান জানাচ্ছেন তার বিপুল এই কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। তিনি এই প্রেরণা কোথায় পেলেন? পেয়েছিলেন তার পিতার কাছ থেকে, বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে। বঙ্গবন্ধু তো শুধু তার পিতাই নন, তিনি যে সমগ্র বাঙালি জাতির পিতা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোনার বাংলার সম্পূর্ণ রূপায়ণের এই প্রত্যয়ে তার সহযাত্রী হওয়ার উদাত্ত আহŸান জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে।

মনে প্রশ্ন জাগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না হয় তার বাবার অনুপ্রেরণায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই যে একটি দেশের সমার্থক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, সেই অনুপ্রেরণা তিনি কোথায় পেলেন। একাই তিনি গোটা জাতিকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো মন্ত্রতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কঠিন সংগ্রামে ঘর ছেড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশের কাজ করার আত্মপ্রত্যয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি নিজেই তখন বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মৃত্যুর মুখোমুখি। অপরের জন্য জীবন উৎসর্গ করার এই আত্মপ্রত্যয় কীভাবে পেলেন অজপাড়াগাঁয়ের এক সচ্ছল মধ্যবিত্ত ঘরের অনাড়ম্বর পরিবেশে জন্ম নিয়ে? কেনই বা আজকের বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পথপরিক্রমায় বারবার তারই স্বপ্নকে ধারণ করে চলেছে? এই আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেক দরদি বাঙালি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটা উদ্ধৃতি দেখে নেওয়া যাকÑ ‘গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় সকলের চেয়ে বড় পথ্যÑ এই শ্রদ্ধার অভাবেই আমরা দেশকে সমগ্রভাবে জানতে পারছি নেÑ ... দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না।’ [গোরা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ^ভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৮২]

রবীন্দ্রনাথের এই কথার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতির কর্ণধার হয়ে ওঠার অন্তর্নিহিত ভাবটি ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে দেখে নিলে কবিগুরুর কথাটি বুঝতে সহজ হবে : সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় গ্রামের গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে। তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব গরিব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। ভালোবেসে বুকে টেনে নিতেন। ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে হয়। স্পষ্টবাদী ও সাহসী মুজিব কিশোর বয়সেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে শেখ মুজিব ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন এবং গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পাস করার পর প্রত্যক্ষভাবে ছাত্র-রাজনীতিতে যুক্ত হন। এর পর নিজগুণে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নেতৃত্বের আসনে আসীন হন। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবা সমিতির সম্পাদক ছিলেন সে সময় তার নেতৃত্বে ‘মুষ্টিভিক্ষা’র মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে গরিব ছাত্রদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই মানবিক নেতৃত্বের প্রেরণা তিনি তার শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। ওই সমিতির সভাপতি ছিলেন তার শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ। রাজনীতির প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের সেবা করা যায়। এর পর তিনি নিজ যোগ্যতার বলেই নেতৃত্বে এসেছেন এবং আমরা দেখেছি প্রতিটি জায়গায়ই রাজনীতির পাশাপাশি তার মানবিক তৎপরতা। যখন যেখানে গিয়েছেন দুঃখী মানুষের কথা বলেছেন। তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের বিষয়ে নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন সেখানে মূল সেøাগান ছিল ‘নিজে বাঁচো ও অপরকে বাঁচতে দাও।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্সের ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে। লাখো মানুষের ওই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। এই সভায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা দাবির পক্ষে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘আমি সরকারের সঙ্গে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করে দেশের উভয় অংশের পক্ষ থেকে দেশবাসীর অধিকারের দাবি উত্থাপন করব। উত্থাপিত দাবি যদি গ্রাহ্য করা না হয় তবে সে বৈঠক থেকে ফিরে এসে দাবি আদায়ের জন্য আমি দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলব। কিন্তু মানুষের প্রেম-ভালোবাসার ডালি মাথায় নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকরি-বাকরি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনের সব পর্যায়ে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব চাই। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি চাই। কৃষকের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য চাই। সাংবাদিকদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই।’ এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। নির্বাচনে জিতেও তিনি ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওই আন্দোলন চলাকালেই ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ এই ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আরও ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ তার এই দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১৪ বছর জেল খেটেছেন। নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য। অর্থাৎ দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাই তাকে জীবন উৎসর্গ করতে প্ররোচিত করেছিল। সমগ্রভাবে তিনি দেশকে, দেশের মানুষকে জানতে পেরেছিলেন বলেই তিনি নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের সঙ্গে নিয়েই সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উদ্ধৃতি দেখে নেওয়া যাকÑ ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সব সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বদেশী সমাজ’, দ্বিতীয় খÐ, বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃ. ৬৩৪)

বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি সংগ্রামে নামেন। তারই ফল স্বাধীন বাংলাদেশ। কারণ তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানিদের উপনিবেশ হয়ে থাকলে এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো উন্নতি হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সচল রূপটি আসলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলারই প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে। কৃষি উপকরণ নিশ্চিত হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আজকে গর্ব করার মতো অবস্থায় উন্নীত হয়েছে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছেÑ সর্বোপরি সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। তবে দ্রæত অগ্রসরমান বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নেই। দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা বজায় রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সংরক্ষণ করাও কম চ্যালেঞ্জিং নয়।

ড. আতিউর রহমান

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

SUMMARY

2029-1.png