বঙ্গবন্ধু এবং পনেরোই আগস্ট-শহীদ ইকবাল


শহীদ ইকবাল 

তেতাল্লিশে পড়ল পনেরোই আগস্ট। এখন থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক তিরোধান ঘটেছিল। তার এ চলে যাওয়া ছিল নিতান্তই অস্বাভাবিক। খুব নির্মম ও রক্তধৃত। অন্যায্য ও ততধিক অন্যায়রূপে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। অনেক কবিতা-গল্প রচিত হয়েছে। তিনি মহান নেতা ছিলেন। তার মতো উচ্চতা কেউ পায়নি। এমনকি মওলানা ভাসানী কিংবা শেরেবাংলা বা সোহ্রাওয়ার্দীও নন। তাদের গুণ-মান উচ্চতার তুলনা করা নয়, এক অর্থে শেখ মুজিব তাদেরই অনুগামী ছিলেন, পরম্পরাটাও নিয়েছিলেন কিন্তু ইতিহাসের অধিষ্ঠানে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন মুজিব। তিনি একটি দেশের স্থপতি। জাতির জাতীয় চেতনার উদ্গাতা, মহানায়কও বটে। এটি অন্যরা পাননি। এ নিয়ে বিস্তর রিসার্চের সুযোগ আছে। এ নিয়ে বিস্তর পাঠ্যও রচনা করা সম্ভব। হয়তো এসব নিয়ে কিছু কিছু কাজও হচ্ছে। কিন্তু মৌলিকত্ব অসামান্যরূপে যে নির্ণিতÑ তা ঠিক বলা যাবে না। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেউ না কেউ এতে নামবে। বিষয়টির বিস্তর ব্যাখ্যার সুযোগ এখানে নেই। বারান্তরে তা একদিন বলা যাবে। ভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু কথা বলব। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ তার কেন্দ্র। প্রাকৃতিকভাবেই সে আবেগ তার চরিত্রে বিধৃত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আমাদের সার্বিক-স্বরূপে এক ধরনের ‘পতন’ ঘটে। এ পতন নানামাফিক। পৃথিবীতে অনেক জাতি-বর্ণ-গোষ্ঠীর মতো বাঙালিরও অনিবার্য কিছু অস্তিত্বপ্রবণ স্মারক আছে। এ অস্তিত্ব-স্মারকচিহ্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্তি¡ক ও রাজনৈতিক। এ বিষয়গুলোকে ঘিরে আবার মানবিক মূল্যবোধ, চিন্তার স্বাতন্ত্র্য, বোধ-ভাবনা তৈরি হয়। বস্তুত, মানুষের সবটাই দাঁড়িয়ে থাকে এ অস্তিত্বিক সত্তার মৌলিকত্বের ওপরে। দেশভাগের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নতি, শ্রেয়োশীলতা, আত্ম-উন্নতি, ব্যক্তিমর্যাদা, জাতিচেতনার বিকাশ সবটা মিলিয়ে মুসলিম বাঙালির লক্ষ্যে এক ধরনের রাষ্ট্রবৈশিষ্ট্যের স্পন্দন গড়ে ওঠে। এ ক্রম-স্পন্দনের কেন্দ্র হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যার সর্বৈব প্রকাশ ঘটে সত্তরের নির্বাচনে। একপর্যায়ে তা হয়ে পড়ে, এই ভ‚খÐের পুরো বাঙালির উদ্ধত শক্তিতে। সাতই মার্চে সে শক্তির অনবদ্য বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়ে। কথাগুলো পেছনের, তবে মনে রাখতে হবে পেছনের ভেতরেই ভবিষ্যতের অঙ্কন নিহিত এবং সেখানেই বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করার পরিসর উৎকীর্ণ। এখানে এসব আপ্তবাক্য বঙ্গবন্ধুকে চেনানোর জন্য নয় বা কোনো সৃজনশীলতায় বঙ্গবন্ধুকে ভক্তির সিঁড়িতে আটকানো নয়, বরং এক বিশাল সামুদ্রিক প্লাবনে কেন তিনি মহীরুহ তা চিহ্নিত করার দায়ে সত্যটি স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠার তাগিদে। যেটি আগেই বলেছি, সাতচল্লিশের পর অন্য অনেক বাগ্মী ও উজ্জীবিত নেতৃত্বের চেয়ে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে, কারণ এই ভ‚খÐভিত্তিক দেশ নির্মাণ এবং সংস্কৃতির ভেতরে জাতিধর্মের উচ্চশির আনত এক প্রাবল্যের অভিমুখটি চিহ্নিতকরণের ত্রাতা হয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং এটিই তার শ্রেষ্ঠত্ব। আজ ইসরায়েল নিজস্ব ভ‚খÐের জন্য আন্দোলন করছে, কুর্দিরা আন্দোলন করছে, তামিলরা আন্দোলন করছে, আবার কোনো কোনো জাতি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়েও গেছে। সুতরাং বাংলাদেশের বাঙালিদের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারে এর যে তাৎপর্যÑ এবং তাতে বিশ্বমানচিত্রে যে নবতর দেশের জন্মÑ তাতে বাঙালিত্বের তাৎপর্য এবং বঙ্গবন্ধুর পরাকাষ্ঠাই অভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। যেখানে তিনি চিরমর্যাদায় সমাসীন। বঙ্গবন্ধুর এই অসীম অক্ষুণœশীল মর্যাদা কেউই কোনোভাবে বিনষ্ট করতে পারবে না। পারেওনি কখনো।

যেমনটা বলছিলাম, পনেরোই আগস্টের প্রেক্ষাপট অনেক আগে থেকেই কার্যত প্রস্তুত ছিল। কুশীলবরা সুযোগ নিয়েছে শুধু। এর কারণ কী? ‘মুসলমানিত্ব’ বা ‘হিন্দুত্ব’ দুটোই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। আর এই সাম্প্রদায়িকতার পেছনে উঠতি পুঁজির এক ধরনের যোগ ছিল। শোষক শ্রেণিও এর সমর্থিত শক্তিরূপে সম্পৃক্ত। ফলে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, ধর্মান্ধ অপশক্তি মুজিবকে খুব সহজ চোখে দেখত না। দেখার কোনো কারণও নেই। এর প্রমাণ মেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় কারা তার পক্ষে ছিল, কারা বিপক্ষে ছিল। ভাষায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই কিন্তু তা সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেÑ সেটি নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়। কারণ কী? অর্থ বা পুঁজির শক্তি। শোষক আর শোষিতের লড়াই। মুজিব যেহেতু মূর্তমান শোষিতের পক্ষে সুতরাং ক্ষমতাকেন্দ্রের বা সাম্প্রদায়িক শক্তির সবাই শোষকরূপে তার বিপক্ষে। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজমন্ত্র ছিল শোষকের শত্রæরূপে, যা মুজিবেরও শত্রæ। উর্দুভাষীরা তাই অহেতুক রাজনীতি দিয়ে বাঙালি মুজিবকে কুক্ষিগত করতে চায়, অন্যায্য অহঙ্কারে ছুড়ে ফেলতে চায়, মিথ্যে দম্ভে পদদলিত করতে চায়। মুজিব তা হননি। এক নিশ্চিত লক্ষ্যে তিনি সমর্পিত ছিলেন। বিসর্জিত ছিলেন। ফলে তাকে দমানো যায়নি। এটাই মুজিবের চলৎশক্তি (শ্রেষ্ঠত্বও বটে)। অন্য নেতাদের থেকে আলাদা এটাই করার শক্তি। এই ভ‚খÐভিত্তিক বাঙালিকে চিনেছিলেন লেখক মীর মশাররফ হোসেন, সেই উনিশ শতকে, বঙ্কিম যুগে জন্মের আর বিশ শতকে মুজিব চিনে ফেলেছিলেন জাতিভিত্তিক ভ‚খÐ। এটি বড় দূরদর্শিতা। তবে আন্দোলনের পরিণতি বা সাফল্যের জন্য ভারতের সমর্থন তিনি পেয়েছেন, বাঙালি তার জাতিসত্তা চিনে নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অকুতোভয় নিয়ে গ্রহণ করেছিল, তীব্র অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে জাতীয় কবি বানিয়েছেÑ ফলে খুব তীব্রতায় চিরসত্যরূপে তার ভ‚খÐের ভেতরে জাত-ধর্ম-বর্ণ ভেদের পার্থক্য ভুলে কোলে তুলে নিয়েছেনÑ লালন, শাহ সুলতান, শাহজালাল, হাসন রাজা কিংবা শাহ আবদুল করিমকে। বাউলদ্রষ্টা লালন অনবদ্যরূপে এ দেশের সমন্বয়ী ধর্মবিশ্বাসের উত্তুঙ্গ প্রতীক। এটি পৃথিবীর কোথাও নেই। বাউল ঘরানার তীব্রতা এখন সবাই গ্রহণ করেছে। কারণ এর বীজ, এ মাটির ও মানুষের সতেজ সংস্কৃতি, বিশ্বমানের স্বীকারোক্তি। ফলে এই চেনার স্বরূপে যে প্রান্তিক ধর্মবিশ্বাস ও ঐক্য, সেটি এই বাংলায় প্রকৃষ্টরূপে নান্দনিক।

শহীদ ইকবাল

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

2028-1.png