বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং কিছু প্রশ্ন


মনজুরুল আহসান খান 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীকস্বরূপ। বস্তুত বাংলাদেশ, তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও স্বপ্নকেই হত্যা করার জন্য এই নির্মমতা। কিন্তু খুনিদের সেই উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাফল্যগুলো একেবারে নস্যাৎ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ আবারও জেগে উঠেছে। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের অব্যবহিত পর দেশব্যাপী কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি কেন এটা একটি বড় প্রশ্ন।

তাৎক্ষণিকভাবে কিশোরগঞ্জ এবং কিছু স্থানে ঝটিকা প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয়। কিন্তু সারাদেশের মানুষ ছিল স্তব্ধ। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। খুনিদের প্রতিরোধ করার জন্য সেনা বা কোনো বাহিনীর ইউনিটকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। একমাত্র সাহসী ব্যতিক্রম কর্নেল জামিল খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন ৩২ নম্বরের দিকে। কিন্তু অকুস্থলে পৌঁছার আগেই বিদ্রোহী সেনারা পথিমধ্যেই তাকে গুলি করে হত্যা করে। বিভিন্ন নিয়মিত বাহিনীপ্রধানরা খুনি মোশতাকের অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিল। সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনী সেদিন কেন অবৈধ ক্যুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

আওয়ামী লীগকেও ঘটনার প্রতিবাদে কোনোরকম উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বরং অধিকাংশ আওয়ামী নেতৃত্ব নিজেদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং গা ঢাকা দেয়। দেশের সেই ভয়ঙ্কর সংকটের সময় আওয়ামী লীগ কি সেদিন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়নি!

ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবদুল কাইয়ুম মুকুল সেদিন ঘটনার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মীদের নিয়ে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের সেদিন খবর ছিল না। মুকুল সেদিন আওয়ামী লীগের কোনো খোঁজ না পেয়ে ফিরে যায়।

কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপের (মোজাফফর) নেতারা সেই সংকট মুহূর্তে সবার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও এগিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে ৪ নভেম্বর আমরা ঢাকার রাজপথে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে মিছিল হতে দেখি। ঢাকা শহরে কিছু প্রতিবাদী লিফলেটও বিতরণ করা হয়। শান্তিনগরের কয়েকজন কর্মী তা বিতরণ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন।

এই মর্মন্তুদ ঘটনার প্রতিবাদে শুরুতেই কেন কোনো গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠল না। এর জবাবে অনেকেই বলেন, ঘটনার আকস্মিকতা এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুই এর জন্য দায়ী। কিন্তু ২৫ মার্চও তো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ তো ছিল না। তার পরও প্রতিরোধ হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে এবং পরে আরও সংগঠিতভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তা হলে কি শেখ সাহেব এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন!

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী দুর্নীতি, লুটপাট, কালোবাজারি ও চোরাচালানি, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিকভাবে এবং স্বাভাবিক আইনে এসব লুটপাট বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি বলেছিলেন, যেদিকে তাকাই আমার লোক, যেদিকে তাকাই চাটার দল। নিরুপায় হয়ে শেখ সাহেব সেনাবাহিনী নামান। এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, এমপি, কর্মী ধরা পড়েন। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে শেখ সাহেবের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। তিনি সেনা অভিযান প্রত্যাহার করে নেন এবং আওয়ামী লীগারদের ছেড়ে দেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা ’৭৫-এর সেনা বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। Ÿঙ্গবন্ধুর কিছু প্রগতিশীল ও গণমুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও সমাজে লুটপাটতন্ত্র ব্যাপক জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং বেশিরভাগ মানুষকে আওয়ামীবিরোধী করে তোলে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করেন। কিন্তু বাকশালেও খোন্দকার মোশতাকসহ বেশিরভাগ লুটেরা প্রতিক্রিয়াপন্থিদের রেখে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় খোন্দকার মোশতাকসহ অনেক আওয়ামী নেতার আমেরিকা, পাকিস্তান ও ভারতের দক্ষিণপন্থিদের সঙ্গে দহরম-মহরমের কথা সবাই জানতেন। বঙ্গবন্ধুও নিশ্চয়ই জানতেন। কিন্তু তার পরও তিনি ওই মীরজাফরদের তার পাশে থাকতে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন। সেটা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

শেখ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশে আমেরিকার কিসিঞ্জার, বিশ্বব্যাংকের প্রধান এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। তিনি সৌদি আরবের সঙ্গেও সখ্য স্থাপন করেন। এসব করার সময় তিনি দুর্দিনের বন্ধু ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করারও কোনো প্রয়োজন মনে করেননি। পাকিস্তানে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময়ও তিনি কারো সঙ্গে এমনকি তার মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। এসব ঘটনা স্বভাবতই বাংলাদেশের ‘পুরনো’ মিত্রদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। এসব একক পদক্ষেপ এবং তার সঙ্গে দেশের মানুষের মধ্যে বিরাজমান তীব্র ভারতবিরোধী প্রতিক্রিয়া ভারত সরকারকে বৈরী করে তুলেছিল বলেই মনে হয়। আমরা দেখেছি ভারত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তার আধিপত্য বজায় রাখতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে না। ২৫ মার্চ ও পরবর্তীকালে ভারতের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই অনেক প্রশ্ন রেখেছেন।

এটা ঠিক, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে খুনের দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা, কানাডায় এখনো কিছু সাজাপ্রাপ্ত বসবাস করছে। কলকাতার বাংলা ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি ভারতের তিহার জেলে বন্দি আছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় ভারতকে জানিয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানানো হবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন এ নিয়ে কোনো আলোচনাই শোনা যায় না। এতবড় হত্যাকা- শুধু কিছু সৈনিকের কাজ হতে পারে না। অবশ্যই রাজনৈতিক মহল এবং আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলো এর সঙ্গে জড়িত ছিল। বিচারের মাধ্যমে সেই চক্রান্তজালও উদ্ঘাটন করার চেষ্টা হয়নি। জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হলেও বিচার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়নি। হত্যাকা-ের দীর্ঘদিন পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সিআইএ, এফবিআই, কেজিবি, আইএসআই, ‘র’ বা ডিজিএফআইর সেই সময়কার দলিলপত্র উপস্থাপিত হয়নি। গোটা ব্যাপারটায় একটা রাখঢাকা গুড় গুড় চলছে।

ইতিহাসের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- ঘিরে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা আজ খুব জরুরি। বাংলাদেশে যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার।

য় মনজুরুল আহসান খান : প্রবীণ শ্রমিক ও বামপন্থি নেতা

SUMMARY

2027-1.png