শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও একজন গবেষকের প্রয়াস


ড. আব্দুল মুহিত 
 

বেশ কয়েক বছর আগে জাতীয় জাদুঘরে একটি আলোচনাসভায় গিয়েছিলাম। সেখানে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদকে বলতে শুনেছিলাম, ‘কেউ যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্টাডি করতে চান, তা হলে তাকে ড. হারুনের শরণাপন্ন হতেই হবে। তার বইয়ে যে সংখ্যক রেফারেন্স থাকে, এতে মনে হয়, ইতিহাসের ওই দিনে, ওই ক্ষণে আমি হারিয়ে গিয়েছি। চোখের সামনে ভাসতে থাকে একেকটি সেøাগান, আন্দোলন।

ওইদিনগুলো বইয়ের পাতায় দেখলে শিহরিত হই আমি।’ কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, টেলিভিশন, পেপার-পত্রিকা, স্মরণসভা, সেমিনারে এ দেশের রাজনীতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। তা দেখে আনন্দে বুকটা ভরে যায়। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এ বক্তব্যগুলো কিছুদিন পর হারিয়ে যায়। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছানো দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন অনন্য গবেষকের নাম বলব।

এ দেশে ‘রাজনীতি ও ইতিহাস’ নিয়ে গবেষণা করার মতো প-িতের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নানা কারণে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। শারীরিক সামর্থ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এর অন্যতম একটি বাধা। এ দেশে গবেষণা করতে গেলে যে পরিবেশ দরকার, তাও পাওয়া কঠিন। এত প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও একজন নীরবে-নিভৃতে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তিনি হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশীদ।

তার ১১টি গবেষণা গ্রন্থের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে-‘দ্য ফোরস্যাডোয়িং অব বাংলাদেশ’, ‘ইনসাইড বেঙ্গল পলিটিক্স’, ‘বাঙ্গালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়’,

‘বাংলাদেশ : রাজনীতি, সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০০০’, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পূর্ণপাঠ’, ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ৬ দফার ৫০ বছর’, ‘মূল ধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’, ‘কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬’, ‘বঙ্গীয় মুসলিম লীগ’, ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ এবং ‘বাঙ্গালির রাষ্ট্রভাবনা ও বঙ্গবন্ধু’।

এ ছাড়া দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক জার্নালে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে ২০ খণ্ডে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া’ রচনা প্রকল্পের প্রধান হিসেবে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত তিনি। এ তো গেল একজন লেখক গবেষকের মেধা ও মননচর্চার অধ্যায়। অন্যান্য ইতিহাসবেত্তা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতো ঘরে বা লাইব্রেরিতে বসে ড. হারুন শুধু লিখে যাননি। হায় হায়! গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল-এই বলে চিৎকার করেননি কিংবা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সেজে টেলিভিশনের টক শোতে গিয়ে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বা তত্ত্ব কপচাননি।

বরং মাঠপর্যায়ে গিয়ে সরাসরি জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের বুঝিয়েছেন, সমন্বিত করেছেন। হাজার বছরের বীর বাঙালির রক্ত আর ঘামের গল্প শুনিয়েছেন তাদের, ঘুম ভাঙিয়েছেন তাদের, আঘাত হেনেছেন চেতনায়। ড. হারুনকে টেলিভিশনের টক শোতে দেখা যায় না বছর-সালে। তবে কালেভদ্রে দেখা মেলে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়। গবেষণার জন্য দিন-রাত ছুটে চলেছেন দেশের নানাপ্রান্তে। আবার প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা, দৃঢ়তা, যুগোপযোগী, আধুনিকতার ছোঁয়ায় গতিশীল ও নবপ্রাণ দান করেছেন এক সময়কার মালবাহী লোকাল ট্রেন হিসেবে পরিচিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। বর্তমানে সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন এনে নজির সৃষ্টি করেছেন। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে আজ সফল তিনি।

আসছে ১৭ মার্চ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চে। আগামী বছর তিনি শতবর্ষে পা দেবেন। কোটি প্রাণ একসঙ্গে গাইবে মহান নেতার জয়গান। মূলত বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যু, রাজনৈতিক জীবন, জেল-জুলুম, প্রতিদিনের কাজকর্ম ও স্বাধীনচেতা, মুক্তিপাগল, আলোর দিশারি, অন্যায়ের প্রতিবাদ, আপসহীন বঙ্গবন্ধু এবং তার স্বপ্ন নিয়ে প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন ড. হারুন-অর-রশীদ। তার গবেষণার মূল উপজীব্য হলো হাজার বছরের বাংলার রাজনীতি, মোগল-ব্রিটিশদের রাজনীতি, বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন ও এর ভিত্তি, ভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগ ও বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব, স্বাধীন অখ- বাংলা রাষ্ট্র ও বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব, স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি।

এ ছাড়া ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা-বাঙালির বাঁচার দাবি, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা এবং বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, নির্বাচন, রাষ্ট্রনীতি, বাকশাল গঠন, শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ও ’৭৫-এ একদল বিপথগামী সেনাসদস্য কর্তৃক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাÑ সব কিছুই উঠে এসেছে ড. হারুনের গবেষণামূলক বইগুলোয়। শুধু তা নয়, দালিলিক প্রমাণাদিসহ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত সহি-শুদ্ধ ও তথ্যবহুল গবেষণা দ্বিতীয়টি মেলা ভার। আর তার ধ্যান-জ্ঞান এখন শিক্ষা, রাজনীতি, সরকার, গণতন্ত্র, আগামীর বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই।

আজ যে গবেষণা গ্রন্থগুলো তিনি রেখে যাচ্ছেন, শত বছর পর তা অমূল্য রতনসম হিসেবে মূল্যয়িত হবে আগামী প্রজন্মের কাছে। এ ধরনের উঁচুমানের গবেষক ও শিক্ষকের কাছে বঙ্গবন্ধুর নামটিই পরম শ্রদ্ধা, ভালোবাসার। অনেকের কাছে ১৭ মার্চ অন্যান্য দিনের মতো একটি দিন হতে পারে। কিন্তু একজন বঙ্গবন্ধু গবেষকের কাছে এদিনটি অনন্য। ওইদিন ঢাকায় সমবেত হবেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা সম্মানিত রাষ্ট্রপ্রধান, নেতাকর্মী, বঙ্গবন্ধুভক্ত, সাংবাদিক ও শুভাকাক্সক্ষী।

এমন শুভক্ষণে ঢাকার আকাশ হবে আলোকিত, বর্ণিল রঙে রাঙাবে নগরী। সব কিছুই দূর থেকে দেখবেন একজন গবেষক। উপলব্ধি করবেন তা প্রতিনিয়ত। হয়তো আবার লিখবেন ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু’, হয়তো আনন্দে কেঁদে ফেলবেন তিনি! ওই অশ্রুও মহাকালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। য় ড. আব্দুল মুহিত : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

2026-1.png