তোমাকে মনে পড়ে-মিল্টন বিশ্বাস

শেখ রাসেল, তোমার জন্মদিনে এই বাংলাদেশ তোমাকে স্মরণ করছে। তোমার স্মৃতিঘেরা আঙিনাগুলো জেগে উঠছে। শ্বেত কপোতের ডানা ঝাপটানো তোমার সকাল, পুকুরে রুপালি মাছের সঙ্গে সাঁতরানো দুপুর, বিকেলে পিতার সঙ্গে গণভবনের লেক মাড়ানোর গল্প অথবা সন্ধ্যারাতের ৩২ নম্বরের হৈচৈ আর শাসন-বারণের নানা আদর তোমাকে জড়িয়ে রেখেছে যত্নে। তুমি নেই তাই ৩২ নম্বর বাড়িটির অবকাঠামো তেমনি থাকলেও পাল্টেছে অনেক কিছুই। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিবের কোলে শুয়ে তোমার ঘুম, বড় বোন হাসু আপার মমতা মাখানো চেয়ে থাকা দৃষ্টি, আর ভাবিদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে তোমার দিন কখন গড়িয়ে গেল রাসেল! তোমার জন্মের পরও বঙ্গবন্ধুকে জেলে যেতে হয় বারবার। তখন তুমি ছোট ছিলে বলে সবার চোখের মণি হয়ে ওঠো। তুমি একটু ব্যথা পেলে সবার মন কেঁদে উঠত। সুন্দর তুলতুলে একটা শিশু কার না প্রিয় হয়! তুমি ছিলে এ দেশের সবার আপন।

২.
শেখ রাসেল, একাত্তরে তুমি ছিলে তোমার প্রিয় সব খাবার থেকে বঞ্চিত, খেলার সাথি ছাড়াই তোমাকে বন্দিশালার জানালা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করা দেখতে দেখতে ৯ মাস কাটাতে হয়েছে। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা দেখার সুযোগ না হলেও রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় তোমার ভেতর মানুষের জন্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল গভীর মমত্ববোধ। ১৭ ডিসেম্বর (১৯৭১) তুমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলে মুক্তির আনন্দ। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করে শত্রু তাড়ানোর সেই উল্লাস পরিবারের সদস্যদের চোখের পানিতে ধুয়ে গেছে। তাদের দুঃখ দেখলে তোমার মন খারাপ হয়ে যেত। অবশ্য যুদ্ধ শেষে কামাল ও জামালকে পুনরায় কাছে পেয়ে পৃথিবী ঝলমল করে উঠলেও তখনো পিতাকে তুমি খুঁজে ফিরছিলে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। এয়ারপোর্টে গিয়েছিলে পিতাকে আনতে। সেদিন লাখো মানুষের ঢলে পিতাকে নিয়ে তোমার খুব গর্ব হয়েছিল রাসেল! সবচেয়ে আনন্দের সেই দিনটি শুধু তোমার নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির ছিল। এ জন্য তুমি যেমন পিতাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে চাইতে না, তেমনি আমাদের জনগণও। তুমি যেন হয়ে উঠলে জনগণের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে এ দেশের মানুষ ভালোবেসেছিল নিঃস্বার্থভাবে; যেমন তুমি পিতাকে। তোমার ভালোবাসার সারণিতে এখনো আমরা দাঁড়িয়ে আছি রাসেল। স্বাধীনতার পর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে আবার তোমার হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো শুরু হয়। সাইকেলে চড়ে তুমি ব্যস্ত হয়ে ওঠো সারা দিন। তারপর পুরনো গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলের সর্বক্ষণিক আনাগোনা। বিকেলে সাইকেলটাও সঙ্গে থাকত। তোমার খুব শখ ছিল মাছ ধরার। তা ছিল খেলা। কারণ মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিতে তুমি। নাটোরের উত্তরা গণভবনেও তোমাকে সে রকমই দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র ছিলে। কিন্তু বাসায় তোমাকে পড়াতে গিয়ে শিক্ষককে তোমার কথাই শুনতে হতো বেশি। তোমার কথায় পড়াতে আসা শিক্ষয়িত্রীকে প্রতিদিন দুটি করে মিষ্টি খেতে হতো। মানুষকে আপ্যায়ন করতে খুবই পছন্দ করতে তুমি। টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে গেলে তোমার খেলাধুলার অনেক সাথি জুটে যেত। প্রত্যেকের জন্য খাবার কিনে দিতে। বেগম মুজিব তাদের জন্য জামাকাপড় নিয়ে যেতেন। গ্রামের শিশুদের সঙ্গে তোমার সেই মৈত্রীর বন্ধন অনেকেই এখনো স্মরণ করেন। তুমি হতে চেয়েছিলে আর্মি অফিসার। কামাল-জামালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে এ অনুপ্রেরণা জন্মেছিল।

৩.
পিতার সঙ্গে রাসেলের সম্পর্ক ছিল চিরন্তন পিতৃহৃদয়ের মমতা মাখানো। পিতাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না সে। যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব প্রধানমন্ত্রী তাকে নিয়ে যেতেন। বেগম মুজিব তার জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ পিতা প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন রাসেলও পরত। পোশাকের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিল। ছেলেবেলা থেকেই তার চরিত্রে দৃঢ়তা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় রাসেলও সেখানে যেতে পেরে আনন্দে মেতে উঠেছিল। তবে মাকে ছেড়ে কোথাও তার থাকতে খুব কষ্ট হতো। বাইরে পিতার সান্নিধ্যে থেকেও মায়ের কথা মনে পড়লেই মন খারাপ করত সে। কারণ বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ সময় জেলে কেটেছে। এ জন্য মাকে কেন্দ্র করে তার প্রাত্যহিক জীবন গড়ে উঠেছিল। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে কামাল ও জামালের বিয়ের অনুষ্ঠানে রাসেল ওর সমবয়সীদের সঙ্গে মিলে রং খেলেছিল। বিয়ের পর সব সময় ভাবিদের পাশে ঘুরঘুর করত সে; কার কী লাগবে খুব খেয়াল রাখত। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা জার্মানিতে স্বামীর কর্মস্থলে যাওয়ার পর রাসেলের খুব মন খারাপ হয়ে যায়।

৪.
শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হঠাৎ জন্ডিস হওয়ায় শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে বেগম মুজিব তাকে আর শেখ হাসিনার সঙ্গে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন তাহলে তাকে আর হারাতে হতো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করা হয় ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইদের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় শেখ রাসেলকে। তার আগে সে বারবার বলেছিল, ‘মায়ের কাছে যাব।’ তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেতেও চেয়েছিল। মায়ের কাছে নেওয়ার নাম করেই হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে। মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৭ দিনের স্বল্পায়ু জীবন ছিল তার। আজ জন্মদিনে তাকে আমরা স্মরণ করছি—একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর অন্তর্বেদনা, তার মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতার সম্পর্ক বোঝার জন্য। প্রাণোচ্ছল শিশু শেখ রাসেল মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছিল, বঙ্গবন্ধুর আনন্দের সঙ্গী ছিল আর বাঙালির চিরন্তন পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনে তার অনাবিল উচ্ছ্বাস ছিল অফুরন্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ রাসেল পিতা-মাতা ও অন্যদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুরতার নির্মম শিকার হয়েছে তা এখনো বিশ্বমানবতাকে বিচলিত করে। আমরা সেই পৈশাচিকতা থেকে আলোর পথে বের হয়ে আসতে চাই। তাই স্মরণ করি শেখ রাসেলকে। 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

2024-1.jpg