বাংলার জনগণ ও বঙ্গবন্ধু

ড. মোহাম্মদ হাসান খান 
   
আমি আজ আমার না দেখা সেই পিতার কথা বলছি, যে পিতা শহীদের জন্য, বীরাঙ্গনাদের জন্য, যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, বাংলার জনগণের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতেন। মাথায় রাখতেন স্নেহের স্পর্শ। নিজের পরিবার নয়, বাংলার জনগণই ছিল তার পরিবার। কারণ তিনি জানতেন, তাকে তার দেশের মানুষ উপহার দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি জানতেন, বাংলার জনগণ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কত ত্যাগ-সংগ্রামে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা।

তিনি ’৭১-এর কত পিতৃহীন পরিবারের আশ্রয়, বীরাঙ্গনাদের মা বলে ডাকতেন। তাদের দিয়েছিলেন পিতৃপরিচয়। যাদের কাছে গেলে তার বজ্রকণ্ঠ হয়ে যেত বেদনাময়। জনগণের সামনে কণ্ঠে নেমে আসত আবেগ, ভালোবাসা। আমার সেই না দেখা পিতা আর কেউ নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫-এ আমার পিতা চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর বয়ে যায় এক বিভীষিকাময় ঝড়। সামরিক স্বৈরাচারী শাষকের পদাঘাতে লুণ্ঠিত হলো আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা।

নির্যাতিত হলেন মুক্তিযোদ্ধারা, আর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। রাজাকার পেল ক্ষমতা। যেসব পিশাচের দল বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতে দ্বিধা করে, ’৭৫-এর পর যারা নানাভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছে, তারা কি পেরেছে বঙ্গবন্ধুকে বাংলার জনগণের মন থেকে মুছে দিতে? বাংলাদেশ, বাঙালি আর বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাংলার জনগণই ছিল পরিবার। সাধারণ মানুষকে পরিবারের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এ কারণেই তিনি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের দিন পরিবারের কাছে ছুটে যাননি, তিনি আগে গিয়েছিলেন তার জনগণের কাছে। জনমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু। জনগণ তার বিকল্প খুঁজে পেল না, আদরের শেখ সাহেব হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু।

পৃথিবীর আর কোনো নেতা তাদের জনগণের ছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। সাধারণ মানুষ, দলের নেতাকর্মী যারাই তার কাছে যেতেন, বঙ্গবন্ধু তাদেরকেই সাদরে গ্রহণ করতেন। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার মানুষের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন। তার এমনি স্মরণশক্তি ছিল, একবার যাকে দেখতেন তাকে আর ভুলতেন না। এমনকি গ্রামগঞ্জের কর্মীদের নাম-পরিচয়ও তিনি ভুলতেন না। কারণ তিনি যে বাংলার জনগণের মাথার ওপর বটবৃক্ষ ছিলেন। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক স্মৃতিচারণে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় ১৯৬৪ সালে। ভিড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে মনে রেখেছিলেন। বছর তিনেক পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার আবার দেখা হয়। তিনি ভাবেননি বঙ্গবন্ধু তাকে চিনতে পারবেন। অথচ বঙ্গবন্ধু তাকে দেখে নাম ধরে ডেকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শুধু রাষ্ট্রপতির ছাত্রজীবনের এমন ঘটনা একটি নয়, অসংখ্য ঘটনা এমন আরও রয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে থেকে কেউ এলেও বঙ্গবন্ধু ওই গ্রামেরই কারো কারো নাম ধরে ধরে তাদের খোঁজখবর নিতেন। বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতেন না।

চিন্তা করতেন দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে। ক্ষমতার চিন্তা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। তাই তো তিনি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছে, তা আমি সারাজীবন মনে রাখব।’ একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠেই এমনভাবে জনগণকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার কথা বলা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব; মনে আছে? আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির আর কোনো নেতা এমন করে গণমানুষের কথা ভেবেছেন? একবার একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি’।

সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার দুর্বলতা কী?।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ কেবল জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে বলে তিনি স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও বঙ্গভবনে যাননি। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন বঙ্গভবনে গেলে কঠিন নিরাপত্তাবেষ্টনীর কারণে সাধারণ মানুষ তার কাছে যেতে পারবে না। তিনি কোনোভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকতে চাননি। তার নিরাপত্তার জন্য হলেও বঙ্গভবনে যাওয়া উচিত, মিত্ররাষ্ট্র ভারতের পক্ষ থেকেও এ কথা বলা হয়েছিল বারবার।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। ভারতীয় মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান ‘ফ্যান্টমস অব চিটাগং’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ করলাম, তার বাসায় কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তার সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, “আমি জাতির জনক, দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।”

আমৃত্যুই বঙ্গবন্ধু হৃদয়ের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য খোলা ছিল। এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ তিনি যখন বক্তব্যও দিতেন তখন সচেতনভাবেই ‘আমি’ শব্দটির পরিবর্তে ‘আমরা’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করতেন। বঙ্গবন্ধুর এই ‘আমরা’র মানে হলো তিনি ও এ দেশের জনগণ। তার যে কোনো নির্দেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করত সাধারণ মানুষ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন বলেছেন, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিস যাবেন না।’ সাধারণ মানুষ তার কথা মেনে নিয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে একই ভাষণে সাধারণ মানুষের প্রতি তার সীমাহীন দরদও ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণে বলেছেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিকশা চলবে।’

চাকরিজীবীদের মাসের নির্ধারিত সময়ে গিয়ে বেতন আনার নির্দেশও দেন তিনি। আক্ষরিক অর্থে ৭ মার্চের দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। একাত্তরে বাঙালিরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলার মানুষ বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু শাসকদের ক্ষমতায় নয়, জনগণের ক্ষমতায় আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন। তার সরকারের আমলে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পর এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন, যে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্তভাবে বসবাস করবে।

তাদের সব নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক হবে বাংলাদেশ। খাদ্যে-বস্ত্রে-চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী হবে। বাংলাদেশের নাগরিক পৃথিবীতে মর্যাদাবান নাগরিক হিসেবে পরিচিত হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুতই দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির জনককে হত্যা করা হলে বাঙালির সোনার বাংলার স্বপ্ন অধরা রয়ে যায়। পঁচাত্তরের পর পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ভর করে বাংলাদেশের ওপর।

মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, পিছিয়ে পড়তে থাকে বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আবারও জাতির জনকের সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোনার বাংলাকে আজ উন্নত দেশে রূপান্তর করছেন, জনগণ শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর মতোই ভালোবাসেন, আমি এবং বাংলার জনগণ চায় বঙ্গবন্ধুকন্যা আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রী থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পঁচাত্তরের পর শত চক্রান্ত করেও কুচক্রী মহল মুছে দিতে পারেনি। বরং ষড়যন্ত্রকারীরাই হারিয়ে গেছে। প্রতিটি বাঙালির মনেপ্রাণে অজেয় মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন, থাকবেন আমৃত্যু। বাংলার আপামর সাধারণ মানুষই তাকে হৃদয়ের সিংহাসনে বাঁচিয়ে রাখবে হাজার হাজার বছর। বীরের নাম রয়ে যায় যুগ থেকে যুগে। কাপুরুষের নাম জেনে নিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। পিতা তুমি যেখানেই থাকো সোনার বাংলার প্রতিটি ধূলিকণা থেকে ঠিক চিনে নেব, তোমাকে, তুলে নেব তোমার প্রাপ্য উপহার। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। য় মোহাম্মদ হাসান খান : প্রাবন্ধিক

SUMMARY

2022-1.jpg