ডা. এস এ মালেক
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের এক নিভৃত পল্লী টুঙ্গিপাড়ায় এমন এক শিশুর জন্ম হয়, যার জন্ম না হলে পূর্ব বাংলা কোনো দিন স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হতে পারত না; তা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ দেশে অনেক বড় বড় নেতা জন্ম নিয়েছেন, তাদের কারোরই অবদান অস্বীকার করার কায়দা নেই। আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে দেশ ও জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মতো নেতা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, এমন অনেক নেতা আছেন। শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সবাই বাঙালি। এদের অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু শেখ মুজিব হচ্ছেন এমন এক বাঙালি নেতা, যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাতিসত্তায় রূপান্তর করে জাতিরাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন সফলতা কেউ ইতোপূর্বে পায়নি এবং আগামীতেও পাবেন না। যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুর অবস্থান অক্ষুুণ্ন থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন করার গৌরব আর কারো পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতাই নন, তিনি গোটা বাঙালি জাতির নেতা। বিশ্বে বসবাসকারী বিভিন্ন বাঙালি জাতির নেতা। বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি বাঙালি রয়েছে। পৃথিবীতে এমন কম দেশই আছে, যেখানে বাঙালি নেই। সব বাঙালি নিয়েই বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করে, তখন বিশ্বের সর্বত্র বসবাসকারী বাঙালিদের প্রথম উদ্ভব হয়। বাঙালির জন্যই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের বাঙালিরাই একটা স্বাধীন ভূমি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই সংগ্রামের একচ্ছত্র নেতা।
দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ফসল হচ্ছে বাংলাদেশ। যা ১৯৭১ সালে ৯ মাসের যুদ্ধ দ্বারা স্বাধীন করা সম্ভব হয়। ২৩ বছরের আন্দোলন ছিল গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ধারায়। কিন্তু ১৯৭১-এর মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর ওই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তর করেন। একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রায়কে মেনে না নেয়ায় বঙ্গবন্ধুকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সশস্ত্র রূপ দিতে হয়। ৩ মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিপ্লবের ডাক দেন। ৭ই মার্চের ভাষণে জনগণকে পরোক্ষভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানান। স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রায় ১০ লাখ আপামর জনতার সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ওই ঘোষণায় পর পরই বাংলার মানুষ বুঝতে পারে, ৬ দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর কৌশল মাত্র। দফা একটাই তা হলো পূর্ব বাংলা স্বাধীন করা। তারপর শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। ৯ মাস ধরে সে সংগ্রাম চলে। শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর হানাদার বাহিনীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালিকে জীবন দিতে হয়। আর কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়।
হানাদার বাহিনী বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। বিদেশের মাটিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে বাঙালি যুবকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রবেশ করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত করে ৯ মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি থাকলেও তারই নামে স্বাধীনতার ঘোষণায় যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এরপর সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে জানুয়ারির ১০ তারিখ বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ২৬ মার্চ থেকেই আমরা স্বাধীন জাতি। ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাঙালিরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তা ছিল বাংলার মাটি থেকে হানাদার বাহিনীকে উৎপাটিত করার যুদ্ধ। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের ও তার পেছনের ইতিহাস সঠিকভাবে পর্র্র্র্র্র্র্র্র্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন যদি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তর করা না যেত, ৬ দফার মতো আন্দোলনের কর্মসূচিভিত্তিক যদি বাংলার জনগণকে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ করা না যেত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যদি শেখ মুজিব ১ নম্বর আসামি না হতেন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিবেশ যদি সৃষ্টি না হতো আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পূর্ব বাংলার বঙ্গবন্ধুর দল না পেত; তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয়ী হওয়ার পর যখন পাকিস্তানের শাসকরা তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ চালায়, তখনই তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হয়। এ ঘোষণা দেয়ার অধিকারও আর কারো ছিল না। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে তার ওপরই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল যে, পাকিস্তানি কাঠামোতে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করা। আর এই কাজটি এমনই কৌশলের সঙ্গে তিনি করেছিলেন যে, পাকিস্তানিরা তার এই কৌশল সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তারা আনতে পারেনি। তিনি প্রমাণ করলেন যে, আক্রমণকারী পাকিস্তান শাসকরা, পাকিস্তান ভাঙার কোনো দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর ওপর পড়ল না। পাকিস্তানিরাই বলতে লাগলেন যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভুট্টোকে বিজয়ী করার জন্যই পাকিস্তান ভাঙার মূল কারণ। বোধ হয় সে কারণেই ভুট্টোকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছেন।
শোনা যায়, ভুট্টো একবার প্রস্তাব করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর ওপর রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্মিলিত দায়িত্ব দেয়া হোক। এও শোনা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরও ভুট্টো নাকি বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদন করেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে যেন অক্ষুণ্ন রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মাটিতে থাকা অবস্থায় তার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা যখন দাবি করি ১৭ মার্চ খোকার জন্ম না হলে, ৭ মার্চ ও ২ মার্চ বিপ্লব কখনই ঘটত না। মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনে অসহযোগ আন্দোলনের মতো যে অদ্বিতীয় ঘটনা পূর্ব বাংলায় ঘটেছিল, তা কি আর কারো পক্ষে ঘটানো সম্ভব ছিল? মার্চ মাসটাই তো পূর্ব বাংলায় স্বাধীন বাংলার মর্যাদা পেয়েছিল। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি কি করে যে তার জনগণকে দেশ শাসন করার অধিকার পায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অসহযোগ আন্দোলন। ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে কি করে শাসন করার অধিকার অর্জন করা যায়, একটা রাষ্ট্রের জন্মের আগে কি করে জনগণের অনুমতিক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করা যায়, গোটা বিশ্বে এর এক অনন্য উদাহরণ শেখ মুজিব। মার্চ মাস ধরেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলার শাসক। তাই পূর্ব পাকিস্তানের মতো পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র এর অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, তবু বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ…। মহান আল্লাহতায়ালা কি এমন একজন নেতাকে পূর্ব বাংলায় জন্ম দিয়েছিলেন, যিনি পূর্ব বাংলার জনগণকে সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এককভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জীবন যুদ্ধে অস্তিত্বের প্রশ্নে আগুন সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বিজয় অর্জন করতে নিবেদিত হননি। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন একমাত্র নেতা, যিনি জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন এবং করে গেছেন। বাংলাদেশের কারণে তাঁকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পর যে গভীর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চক্রান্ত পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ স্বাধীন করা থেকে বিরত করতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও তার প্রতিশ্রুতি ও আদর্শকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবিপ্লবীদের হাতে বাংলাদেশ বিপযস্ত হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করার। বঙ্গবন্ধুর জন্য বাঙালি জাতি আজ গর্বিত ও ধন্য।
ডা. এস এ মালেক :রাজনীতিক ও কলাম লেখক।