এস. এম. রুহুল আমীন (রিজভী)
ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনীই নন, তিনি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অপ্রাণ প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন বেগম মুজিব। আজ এই মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৭তম জন্মদিন আজ। গোপালগঞ্জে টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজকের এই দিনে বঙ্গমাতাকে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত, যে রাতে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিলো নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত ভাবে একই দিনে সেই হত্যাকারীদের শিকার হয়ে তিনিও শাহাদাৎ বরণ করেন।
মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতা ও ৫ বছর বয়সে মাতাকে হারান শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার ডাক নাম ছিল ‘রেনু’। তার পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ কাসেম চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ দেন। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সাহেরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। তিনি প্রাথমিক লেখাপড়া করেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। এরপর সামাজিক রীতি-নীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ও পাঠ্য বইয়ের বাইরে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। টুঙ্গীপাড়া গ্রামে শেখ বাড়িতে পরিবারের ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য মৌলভী এবং বাংলা, ইংরেজি ও অংক শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল। পরিবারের সকল শিশু-কিশোর বিশেষ করে মেয়েরা বাড়িতেই শিক্ষা গ্রহণ করতো।
গোপালগঞ্জের (তৎকালীন ফরিদপুর) টুঙ্গীপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ের সন্তান শেখ মুজিব দীর্ঘ আপোষহীন লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে শুধুমাত্র বাঙালি জাতির পিতাই নন, বিশ্ব বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। আর তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁরই সহধর্মিনী, মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেফতারের হুমকি দেয় তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু তবুও তিনি অবিচল থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তার অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা ও আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়াসহ প্রতিটি কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতেন তিনি।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেপথ্যে থেকেই তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পৌছে দিতেন তিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। মনেপ্রাণে তিনি একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোনো পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। তার কোনো বৈষয়িক চাহিদা ও মোহ ছিল না। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের রোগে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর নেয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোনো সংকটে পাশে দাঁড়াতেন।
এই মহীয়সী নারী আমাদের অহঙ্কার। তিনি ছিলেন বাঙালি নারীর আদর্শ প্রতিকৃতি। বঙ্গমাতা যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এই মহান নারীর জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হবে দেশপ্রেমে। তারা ধারণা পাবে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে।