এস. এম. রুহুল আমীন (রিজভী)
১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে লন্ডন-দিল্লি হয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। বাঙালিকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ এনে দেওয়ার লড়াইয়ে এ মহানায়কের দেশে ফেরার দিনটি এক অনন্য ক্ষণ।
১৯৭২ সালের এই দিনে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বাহনে চেপে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় প্রিয় মাতৃভূমিতে অবতরণ করেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন ও আনন্দমুখর মুহূর্ত। একদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বজন হারানোর বেদনা ও শোক, অন্যদিকে নানা শংকা ও হতাশার মাঝে আশার আলো হিসাবে আগমন ঘটে প্রিয়নেতার। এ কারণে বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সভামঞ্চ পর্যন্ত দেখা দেয় জনসমুদ্রের ঢেউ। সর্বকালের সর্ববৃহত্ এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তা ছিল খুবই হূদয়স্পর্শী ও উদ্দীপনামূলক। ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে যেখানে দাঁড়াইয়া তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, এই দিন একই স্থানে তিনি শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের আহ্বান জানান। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় পূর্ণতা পায়। এজন্যই ইতিহাসে এই দিবসটি অনন্য ও মহিমান্বিত।
বঙ্গবন্ধুর এই আগমনে দেশ একটি মহাদুর্যোগের হাত হতে রক্ষা পায়। সে সময় ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান এক সম্পাদকীয়তে লিখে, তাঁর এই মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার সুযোগ দিয়েছে। এর আগে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাপ্রকোষ্ঠে অন্তরীণ থাকাকালে তাঁর জীবন নাশের উপক্রম হয়েছিল। প্রহসনমূলক বিচারের রায় অনুযায়ী তাঁর ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য কবরও খনন করা হয়েছিল। এই সময় তিনি বীরের ন্যায় বলেছিলেন, ‘আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও’। কোন প্রলোভন ও ভয়-ভীতিই তাঁকে বাঙ্গালির জনদাবি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ হইতে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর দৃঢ়তার কারণে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর কনফেডারেশনের স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অধিক প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি সশরীরে না থাকলেও ছিলেন সবখানে। পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল যে, জননেতা ১১ শত মাইল দূরে কারাগারে অবস্থান গ্রহণ করলেও তাঁর নামের উপর ভিত্তি করে একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। তাঁর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পিছনে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির বিশ্বজনমত সৃষ্টি ও অন্যান্য অবদান অনস্বীকার্য ও চিরস্মরণীয়। এর পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিত্রবাহিনীর সেনা প্রত্যাহার, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিকসহ সার্বিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘের সদস্য লাভ প্রভৃতি কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।
প্রত্যাবর্তনের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘ইনশাল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি, তখন স্বাধীন থাকবো। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে কেউ আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারবেন না।’ স্বাধীনতাকে সার্থক ও চির অক্ষয় করে রাখার জন্য তিনি সর্বাগ্রে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেন।
তাঁর ভাষায়, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি, বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’