বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

হারুন হাবীব

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমহিমায় বরণ করা, মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর অবিকৃত ইতিহাসে ধারণ করা- কোনো সন্দেহ নেই এই উচ্চারণে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আমরা কেবল উত্তরোত্তর সংকটেই জর্জরিত হবো। বঙ্গবন্ধুর যারা দলগত অনুসারী, তাদেরও উচিত হবে জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ না করে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই শুদ্ধতম ও শ্রেষ্ঠতম নেতাকে সর্বজনীন করা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট নিয়ে নানামুখি বিশ্লেষণ দেয়া হয়। দেশ ও দেশের বাইরের পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ আবার বিষয়টাকে অতি-সরলিকরণ করেও দেখার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ এটিও মনে করেন যে, এ সংকট শেষ হওয়ার নয়। কারণ হিসেবে তারা দুটি বড় দলের কঠোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।

কিন্তু আমার মনে হয় এই পর্যবেক্ষণগুলো সংকটের গভীরে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, এই সংকটের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিপন্ন হতে থাকবে, কাক্সিক্ষত স্থিতিশীলতা পিছিয়ে যাবে এবং দেশ তার প্রার্থিত শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে। এটিও সত্যি যে, এই পরিস্থিতিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করবে সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় উগ্রবাদী বা জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজো মেনে নেয়নি। সুযোগটি আরো গ্রহণ করবে যারা ভ‚-রাজনৈতিক কারণে এই জনপদে অস্থিতি জিইয়ে রাখার পক্ষপাতী।

কাজেই সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন জরুরি বৈকি। এই মূল্যায়ন বা উপলব্ধি যত দ্রুত ঘটে ততই মঙ্গল। কারণ সাধারণ মানুষ সংকটের সমাধান চায়, তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। দেশে বহুদলের, বহুমতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ চায় তারা; যে সংস্কৃতিতে দলীয় যুদ্ধের দামামায় রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না, বাংলাদেশ লক্ষ্যচ্যুত হবে না, মুক্তবুদ্ধিচর্চা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন হবে না। বরং এমন এক ঐতিহ্য স্থাপিত হবে- যা এই ভূখণ্ডের মানুষকে উত্তরোত্তর আধুনিক জাতিতে রূপান্তরিত করবে।

দ্বিমতের কারণ নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আরোপিত এবং পরিকল্পিত; রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মধ্য দিয়ে, লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে যার যাত্রা। একাত্তরের ইতিহাসের প্রতি বৈরিতা ও পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার মৌলিক প্রতিবন্ধক। এটিও মনে করার কারণ আছে যে, একাত্তরের পরাজিতরাই খোলস বদলে পঁচাত্তরের কুশীলব হয়েছিল, যারা ভেবেছিল রাষ্ট্রপিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের সকল অর্জন ধূলিস্যাৎ করা সম্ভব হবে। হয়তো তারা চেয়েছিল, মুসলমান প্রধান একটি জনপদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আধুনিক এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পত্তন করার সাফল্য দেখিয়েছেন, তাকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করা সম্ভব হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আশা পূরণ হয়নি। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ইতিহাসের শক্তি প্রত্যাঘাত করেছে, সাময়িকভাবে হলেও একাত্তর ও পঁচাত্তরের কুশীলবরা পর্যদুস্ত হয়েছে, বাংলাদেশ আবারো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

ব্রিটিশ ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভক্তির পর যুক্ত পাকিস্তান টিকেছে তেইশ বছর। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র চার যুগেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে এরই মধ্যে। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার পরও এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানুষ, যারা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’কে ভুল প্রমাণ করেছিল। নতুন নাগরিকরা আজ সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে, জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা ও খেলাধুলায় অবাক করা সাফল্য বয়ে আনছে। কিন্তু এই নতুন নাগরিকদের একটি তাৎপর্যময় অংশের মন থেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন দূর করা সম্ভব হয়নি বলে আমার ধারণা। এরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছে যে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদ; দেখছে, দীর্ঘকাল পরেও, রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে; মুক্তচিন্তা, যা আধুনিক সমাজ নির্মাণের মৌল উপাদান, তাকেও গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে জঙ্গিরা! আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুবাদে এসবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে দেশেরই কিছু রাজনৈতিক দল, যাদের সাথে গাঁট বেঁধেছে ধর্মের নামাবলি গায়ে চরানো স্বাধীনতাবিরোধী চক্র! ইত্যকার কারণেই সংকট থেকে নতুন মানুষদের মুক্তি দিতে হবে, সৎ ও সত্যের পথে তাদের অগ্রসর করাতে হবে।

অতএব মূলে ফিরে যেতে হবে, অবিমৃষ্যকারিতার আবরণ খুলে উদারচিত্তে সামনে এগুতে হবে। কারণ জাতীয় ভিত্তিমূলে ফিরে যেতে না পারলে সংকট দূর হবার নয়। এক-দুটো নির্বাচন বা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব হবে না। সে কারণেই প্রয়োজন জাতীয় সাংস্কৃতিক জাগরণ, যা কুলষিত মননকে পরিচ্ছন্ন করবে।

অনুধাবন করতে হবে যে, স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকেই পরিকল্পিত পন্থায় পরাজিত শক্তির ক্রমাগত আগ্রাসনে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিমূল থেকে বাঙালিকে দূরে সরানোর কৌশল চলে আসছে। এসব করা হয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়, যা সময়ের ব্যবধানে মহীরুহ হয়ে ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০। গুরুত্বপূর্ণ এ সময়কালে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে অবৈধ সেনাপতি শাসকদের হাতে, কিংবা তাদের হাতে গড়ে তোলা হঠাৎ গজানো রাজনীতিবিদের হাতে। বাংলাদেশের সীমানায় এরা নতুন করে আরেকটি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে, যে সাম্প্রদায়িকতাকে বিতারণ করা হয়েছিল ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে, তাকে নতুন করে জাগরুক করা হয়েছে। ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকদের হাতে রাষ্ট্রের স্থপতি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন; উপেক্ষিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও আদর্শ। ফলে গজিয়েছে নানা পরগাছা। এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসেছে; তারা ধনেজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসবের সবই করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে মুসলমান প্রধান এই বাংলার জনপদে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক উদার সংস্কৃতির রাষ্ট্রটি ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় লাখো মানুষের আত্মদানের মুক্তিযুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল।

নানা পালাবদরের পর, বিশেষ করে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী সফল আন্দোলনের পর থেকে রাষ্ট্রের আশা জাগানিয়া গণতান্ত্রিক নবযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সে যাত্রাটিও মসৃণ হতে পারেনি। বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বিকাশ। এর প্রধান কারণ এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও অবিকৃত ইতিহাস সংরক্ষণের প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার প্রশ্নে প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছিল সেনাপতি-রাজনীতিবিদ ও তাদের সৃষ্ট দলগুলো। এরা বিস্ময়করভাবে অস্বীকার করে গেছে বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে; আঘাত হেনেছে বাঙালি সেক্যুলার সমাজশক্তির প্রতিটি স্তম্ভে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে এরা উৎসাহিত ও পুনর্বাসিত করেছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি প্রেতাত্মার লালন করেছে! এ যেন তাদের আরেক যুদ্ধ, একাত্তরের রণাঙ্গনে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ!

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এই বৈরিতায় জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লাভবান হয়নি তারাও যারা ইতিহাস হত্যার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। বরং এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের যাত্রাপথ কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে, জনগোষ্ঠী উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছে, সংকট গ্রাস করেছে সমাজকে। আর দুর্ভাগ্যজনক এই প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা ও সমাজ প্রগতির চিহ্নিত প্রতিপক্ষরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা সংঘবদ্ধ হয়েছে।

কিন্তু ইতিহাসের নিজস্ব শক্তিকে ঠেকানো যায়নি, যা ফিরে এসেছে আবারো। শত প্রতিবন্ধকতার পরও ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকানো যায়নি, যদিও তাকে ঠেকাবার সব চেষ্টা হয়েছিল। এমন কি বিচার ঠেকানো যায়নি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের, যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে ধর্মের নামে এ দেশের মাটিতে নির্বিচার গণহত্যা ও নির্বিচার নারী নিগ্রহ করেছিল ১৯৭১ সালে।

দেরিতে হলেও ইতিহাসের অমোঘ সত্য দুয়ারে কশাঘাত করেছে। জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নিরন্তর বিষবাষ্প ছড়ালেও নতুন প্রজন্মের বৃহৎ অংশ মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নতুন মানুষেরা বিকৃত ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায় ও সত্যের পক্ষ অবলম্বন করতে আগ্রহী হয়েছে। নতুন প্রজন্মের এই মনোজাগতিক উত্থান ইতিহাসেরই আরেক আশীর্বাদ।

অন্যদিকে নানা আঘাতে দীর্ঘকাল পর্যুদস্ত থাকা পরও মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়েছে। এ শক্তিকে অদূর ভবিষ্যতে খর্ব করা যাবে ভাবা ঠিক হবে না। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, সে কারণেই, একটি গুণগত পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। পুরনো ব্যর্থতা ও কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে ন্যায় ও সত্যকে গ্রহণ করা জরুরি। আমার বিশ্বাস, পরিবর্তনের এই ধারাটি সূচনা করে রাজনীতিতে সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব, জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধাটি দূর করা সম্ভব। এ পরিবর্তনের মূল শর্ত- অতীতের ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ঐতিহাসিক মহিমায় গ্রহণ করা, তাঁর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জ্ঞাপন করা, হত্যাকারীদের বিচারকে সমর্থন করা; মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী তস্করদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আকণ্ঠ সমর্থন দান করা, যা জাতীয় ঐকমত্যের মৌল শর্ত।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা অপরাধ কিছু নয়, যদিও সত্য এই যে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি, নানা সংকট-সীমাবদ্ধতার পরও, আজো অসাম্প্রদায়িক সমাজশক্তির মুখ্য দল। অপরাধ হচ্ছে, এই দলটির বিরোধিতার নামে জাতির জনককে অবজ্ঞা করা, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, বিতর্কিত করা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের সাথে আঁতাত করে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।

আমি জানিনে, আত্মঘাতী চেতনার এই ধারকরা তাদের কলঙ্কময় অবস্থান পাল্টাবে কিনা, বাংলাদেশ বিরোধী ও রাষ্ট্রের মৌল চেতনাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গ ছাড়বে কিনা। যদি করে তা হবে বড় লাভ; আর যদি তা না হয় তাহলে দুই বিবদমান শিবির মুখোমুখি থাকবে, হয়তো আরো অনেক কাল, যা দুর্ভাগ্যজনক।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় সমঝোতার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে- নিঃশর্ত এবং পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক সততা ও আবেগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রহণ করা, একই সঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা। যতদিন না এ কাজটি করা সম্ভব হবে ততদিন সংকট জিইয়ে থাকবে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাবার্ষিকী পালিত হয় প্রতি বছর, পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস। কেবল আওয়ামী লীগ নয়, নানা মতপথ থেকে এ দিনে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, যা ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। লক্ষ করার বিষয় যে, বেশ কিছু দলগোষ্ঠী আজো জাতীয় ঐক্যের সঠিক উপলব্ধিতে আসতে পারেনি, পারলে ঐক্যের পথে বড় বাধাটি দূর করা সম্ভব হতো। পূর্ণ উপলব্ধিতে সবাইকে বুঝতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আর কোনো দলের নন, ইতিহাস পরিক্রমায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, জাতির জনক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, এবং যা অলঙ্ঘনীয় সত্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমহিমায় মান্য করা, মুক্তিযুদ্ধকে তার অবিকৃত ইতিহাসে বরণ করা। এর ব্যতিক্রম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দলের যারা অনুসারী, তাদেরও উচিত হবে জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ না করা, সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ এই বাঙালিকে সার্বজনীন করা।

কাজেই মূলে ফিরে যে হবে। নির্মোহভাবে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এক-দুটো নির্বাচন বা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব হবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- এই মনোভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র লাভবান হয়নি, বরং কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে, জাতি উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছে, একের পর এক সংকট গ্রাস করেছে রাষ্ট্রকে। অন্যদিকে দুর্ভাগ্যজনক এই প্রক্রিয়ায় দেশের স্বাধীনতার চিহ্নিত প্রতিপক্ষরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্রমাগত আঘাতে দীর্ঘকাল পর্যুদস্ত থাকলেও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি আগের যে কোনো সময়ের চাইতে শক্তিশালী হয়েছে। তারা তাদের ব্যর্থতা, বিভেদ ও আত্মতুষ্টির প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছে। দিন যত যাবে ততই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অপ্রতিরুদ্ধ হবেন- আজ যা তার চাইতেও বেশি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমহিমায় বরণ করা, মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর অবিকৃত ইতিহাসে ধারণ করা- কোনো সন্দেহ নেই এই উচ্চারণে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আমরা কেবল উত্তরোত্তর সংকটেই জর্জরিত হবো। বঙ্গবন্ধুর যারা দলগত অনুসারী, তাদেরও উচিত হবে জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ না করে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই শুদ্ধতম ও শ্রেষ্ঠতম নেতাকে সার্বজনীন করা। তাঁর আদর্শকে সত্যিকার মর্মে উপলব্ধি ও বেগবান করা। আমার বিশ্বাস, টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত থেকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ও আগামীকালের জাতিবিরুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিরুদ্ধ সব আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক হবেন, যেমনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করে জাতিকে দীর্ঘলালিত কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি শুরু করার সিদ্ধান্ত, বিশেষত চার দশকের ভয়ঙ্কর সব ঘটনাপ্রবাহের পর, খুব সাধারণ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। কাজেই বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে। প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি মহলের প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে জাতীয় দায়বদ্ধতা পূরণের পথে।

কোনো সরকার, ক্ষমতাসীন দল বা জোটের কার্যক্রম সমালোচনা বা সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। সে কারণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকার বিরোধীদের স্বাধীন কার্যক্রম জরুরি। এ ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সমন্বয়ে যে মোর্চা তারা রাষ্ট্রের মৌলিক ইতিহাস ও চেতনার প্রতিপক্ষ, প্রতিপক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের। কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত, যে বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতার প্রাপ্তিকে ছিনতাই করা হয়, যে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয় পাকিস্তানি রাজনীতিধারায়, সেই বাংলাদেশের হৃতগৌরব উদ্ধারে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী নেতৃত্ব ইতিহাসের নতুন আশীর্বাদ বৈকি।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র চার যুগ পরও কঠিন সময়ের মুখোমুখি। কাজেই একটি বা দুটি ‘ব্যাটল’-এ জয়ী হয়ে আত্মতুষ্টি পাওয়ার সুযোগ কোথায়?

সে কারণেই বলি, রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জেতার জন্য প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরি করা। ভুলে গেলে চলবে না যে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শত্রুরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধে নেমেছে। কাজেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমার বড় দুঃখ হয় যখন দেখি- আদর্শিক রাজনীতির ক্রমান্বয় পতন ঘটছে; রাজনীতি কেবলই স্লোগান সর্বস্ব হয়ে উঠছে; যা হয়তো সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম- কিন্তু বৃহৎ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নয়।

SUMMARY

201-1.jpg