বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবঃ প্রথম দেখার অমলিন স্মৃতি

নূর মোহাম্মদ কাজী
।। টরন্টো, কানাডা থেকে ।।
এক সূর্যস্নাত শীতসকালে আমি প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি। এটা আমার কিশোর বয়সের স্মৃতি। যদ্দূর মনে পড়ে সময়টি ছিল ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী। আর স্থানটি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান গেইটের সামনের চত্ত্বর। এদিন তিনি মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সাথে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসে ছিলেন।
আমার বাবা মৌলভী আমীর কাজী ছিলেন মওলানা ভাসানীর অনুসারী। তিনি এদিন সকালে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত প্রভাত ফেরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। অতিরিক্ত ভীড়ের কারনে বা’জান আমাকে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বা’জান মওলানা ভাসানীকে দেখিয়ে বলেছিলেন, -ইনি হলেন আমাদের নেতা মওলানা ভাসানী হুজুর। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, -বা’জান উনার পাশে দাঁড়ানো ঐ লম্বামত লোকটি কে? বা’জান বললেন, -তিনি হলেন আমাদের যুব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এরা দু’জনেই আমাদের নেতা। বাংলার দুঃখী মানুষের নেতা।
বড় হয়ে যখন ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনারে প্রতি বছর আসতে লাগলাম, তখন আমার মনের গহীনে বিরাজমান শহীদ মিনারে শুধু সালাম, বরকত, রফিক, জব্বরের স্মৃতি নয়, এর সাথে যুক্ত হতে লাগল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের স্মৃতি।
একনদী রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশের জন্য এত রক্ত দান, এত আত্মত্যাগ পৃথিবীর আর কোন জাতি করে নাই। এটাই ধারনা ছিল বহিরাগত কেহ আর আমাদের রক্ত ঝরাতে আসবে না। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশেও আজ বাঙালি সন্তান শহীদ হচ্ছে। এ শহীদের কাতারে সামিল হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম, নজরুল-তাজউদ্দিন-মনশুর আলী- কামরুজ্জামানের নাম। অগণন শহীদের স্মৃতিতে হতাশ হয়ে কবি শামসুর রহমান তাই বলেছিলেন- “তবে কি আমার বাংলাদেশ হয়ে যাবে এক সুবিশাল শহীদ মিনার”?
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির সূর্যস্নাত শীত সকালের নেতা ছিলেন। তাঁরা আমাদের স্বপ্ন জাগানিয়া নেতা ছিলেন। আমাদের সময়কালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। এরা আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো একটি জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। এ সর্বশ্রেষ্ঠ কাজে এরা আমাদের সব চাইতে সাহসী নেতা ছিলেন। এ দু’নেতাকে সামনে রেখে আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করার জন্য জীবন দানের প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।
অবশেষে ৩০ লক্ষ ভাই-বোনের শহীদী রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব কথা স্বীকার না করলে আমি নূর মোহাম্মদ কাজী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ করেছি- তা জিরো হয়ে যায়।
আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করতে পারি না। কারন সর্বশেষ তার নেতৃত্বেই আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। মনে রাখতে হবে যে, ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বের আদল ছিল পিতা-পুত্রের নেতৃতের আদল। বাংলাদেশের স্মৃতি মনে এলে এ দু’নেতার স্মৃতি আমার মনে একত্রে ভেসে উঠে। ভেসে উঠে সূর্যস্নাত শীত সকালে অসংখ্য মানুষের মাঝে উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা এ দু’নেতাকে, যাদেরকে আমি প্রথম দূর থেকে দেখেছি। সেদিন থেকেই এ দু’জনকে আমি নেতা মেনেছি।
বা’জান বলেছিলেন এরা বাংলার দুঃখী মানুষের নেতা। সেই থেকে এ দু’নেতা আমার জীবনে অখন্ড আদর্শের প্রতীক। এদের আদর্শ অলক্ষ্যে আমার আদর্শে পরিনত হয়েছে। এদের জীবনাচার আমার জীবনাচারে পরিনত হয়েছে। এদের জাতিত্ব আমাকে জাতিত্ব দিয়েছে। এদের বাঙালিত্ব আমাকে বাঙালিত্ব দিয়েছে। এদের নেতৃত্বে বিকশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা বহন করার প্রতিজ্ঞা আমি করেছি। সেই থেকে আমার সংগ্রামের শেষ নেই। ইতোমধ্যে আমি কৈশোর, তারুন্য, যৌবনকাল পার করে পৌঢ়ত্ত্বের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। ভাসানী-মুজিবের স্মৃতি আমার জীবনে উদ্দীপনার শক্তি। এদের কথা মনে এলে জাতীয় শহীদ মিনারের সূর্যস্নাত শীত সকালের কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি ভাসানী-মুজিব আমার সাথে আছেন। নিমেষে আমার মন আলোকিত হয়ে যায়। আমি নিজকে ঐতিহ্যশালী ও সমৃদ্ধশালী (Heritage) মনে করি। আমি মনে করি আমার হারাবার কিছু নেই। আমার সব কিছুই আছে। আমার জাতি আছে, আমার দেশ আছে, আমার আদর্শ আছে।
যুগ যুগ জিও তুমি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব!

SUMMARY

2009-1.jpg